এথনিক গোষ্ঠীর বৈশিষ্ট্য

এথনিক গোষ্ঠীর বৈশিষ্ট্য সমূহ লিখ। [NU- 2022] ★★★

ভূমিকা: এথনিক গোষ্ঠী বা নৃগোষ্ঠী হলো এমন জনগোষ্ঠী, যারা অভিন্ন ভাষা, সংস্কৃতি, জীবনধারা ও ঐতিহ্যের মাধ্যমে নিজেদের স্বতন্ত্র পরিচয় বহন করে। এ জনগোষ্ঠীর ধর্ম, ভাষা, খাদ্যাভ্যাস, সামাজিক আচার-আচরণ এবং ঐতিহাসিক পটভূমির ওপর ভিত্তি করে তাদের বৈশিষ্ট্য নিরূপণ করা যায়। বাংলাদেশে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, মণিপুরী, সাঁওতালসহ বহু নৃগোষ্ঠী রয়েছে, যারা প্রত্যেকেই নিজেদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য ধারণ করে। 

এথনিক গোষ্ঠীর বৈশিষ্ট্যসমূহঃ প্রতিটি এথনিকগোষ্ঠীর কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য রয়েছে যার মাধ্যমে তারা একে অপর থেকে স্বতন্ত্ররূপে আত্মপ্রকাশ করে। এথনিক গোষ্ঠীর বৈশিষ্ট্যসমূ নিম্নরূপ—

১. অভিন্ন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য: প্রত্যেক এথনিক গোষ্ঠীর নিজস্ব সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য রয়েছে, যা তাদের স্বতন্ত্র পরিচয় কে তুলে ধরে। তাদের ভাষা, ধর্ম, খাদ্যাভ্যাস, পোশাক, আচার-অনুষ্ঠান ও জীবনধারার মাঝে এক ধরনের ঐক্য বজায় রাখে। যেমন: চাকমাদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক, মারমাদের সাংগ্রাই উৎসব, মণিপুরীদের রাস নৃত্য ইত্যাদি।

২. সাধারণ ভাষা: প্রত্যেক নৃগোষ্ঠীর সদস্যরা সাধারণত একটি নির্দিষ্ট ভাষায় কথা বলে যা তাদের সাংস্কৃতিক ঐক্যকে শক্তিশালী করে। ভাষার মাধ্যমে তাদের ইতিহাস, লোককাহিনি এবং ঐতিহ্য সংরক্ষিত হয়। যেমন: চাকমারা চাকমা ভাষায়, ত্রিপুরারা ককবরক ভাষায় এবং মণিপুরীরা মৈতৈ ভাষায় কথা বলে।

আরো পড়ুন: প্লেটোর সাম্যবাদ তত্ত্বটি আলোচনা কর।

৩. ধর্মীয় বিশ্বাস ও আচার-অনুষ্ঠান: নৃগোষ্ঠীগুলোর নিজস্ব ধর্মীয় বিশ্বাস ও উপাসনার পদ্ধতি রয়েছে যা তাদের জীবনযাত্রার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তাদের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে প্রবাহিত হয়। যেমন: রাখাইন ও মারমারা মূলত বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী, খাসিয়ারা খ্রিস্টধর্ম এবং গারোরা মাতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার অনুসারী। 

৪. আত্মপরিচয়ের অনুভূতি: নৃগোষ্ঠীর প্রতিটি সদস্য নিজেদের একটি বৃহত্তর সাংস্কৃতিক ও সামাজিক পরিবারের অংশ মনে করে। তারা সকলে তাদের নিজস্ব রীতিনীতি, কৃষ্টি ও ঐতিহ্য সংরক্ষণে সচেষ্ট থাকে। যেমন: সাঁওতালরা তাদের আত্মপরিচয়ের প্রতীক  হিসেবে  নিজস্ব নৃত্য ও বাদ্যযন্ত্র সংরক্ষণ করে। 

৫. পারিবারিক ও সামাজিক কাঠামো: নৃগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে শক্তিশালী পারিবারিক বন্ধন থাকে। তাদের সমাজব্যবস্থা পিতৃতান্ত্রিক বা মাতৃতান্ত্রিক হতে পারে। পরিবার ও সম্প্রদায়ের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা ও নির্ভরশীলতা বিদ্যমান। যেমন: গারোদের মাতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় কন্যার মাধ্যমে সম্পত্তির উত্তরাধিকার নির্ধারিত হয়।

৬. নির্দিষ্ট ভৌগোলিক বিস্তৃতি: নৃগোষ্ঠীগুলো সাধারণত নির্দিষ্ট ভৌগোলিক অঞ্চলে বসবাস করে এবং তাদের জীবনধারা সেই অঞ্চলের জলবায়ু ও ভূপ্রকৃতির সঙ্গে মানিয়ে চলে। যেমন:  পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকমা, সিলেট অঞ্চলে খাসিয়া  বসবাস করে।

৭. নির্দিষ্ট জীবিকা ও অর্থনীতি: নৃগোষ্ঠীগুলোর জীবিকা সাধারণত তাদের ঐতিহ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকে। কৃষিকাজ, পশুপালন, তাঁতবয়ন, শিকার এবং হস্তশিল্প তাদের প্রধান জীবিকার মাধ্যম। যেমন: মারমারা জুম চাষ করে, খাসিয়ারা পান চাষের জন্য বিখ্যাত, আর মণিপুরীরা তাঁতশিল্পের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে।

আরো পড়ুন: গ্রামীণ সমাজের প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট

৮. সামাজিক বিধান ও প্রথা: প্রতিটি নৃগোষ্ঠীর নিজস্ব সামাজিক বিধান ও নিয়ম-কানুন থাকে যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে প্রবাহিত হয়।  

৯. ঐতিহাসিক পটভূমি ও কিংবদন্তি: প্রত্যেক নৃগোষ্ঠীর নিজস্ব ইতিহাস, কিংবদন্তি ও পূর্বপুরুষদের নিয়ে বিভিন্ন বিশ্বাস থাকে যা তাদের স্বতন্ত্র পরিচয়কে দৃঢ় করে। যেমন: চাকমারা একসময় আরাকান রাজ্যের অধিবাসী ছিল এবং পরবর্তীতে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসতি স্থাপন করে।

১০. ঐতিহ্যবাহী উৎসব ও সাংস্কৃতিক রীতি: প্রত্যেক নৃগোষ্ঠীর নিজস্ব উৎসব, নৃত্য, গান ও শিল্পকর্মের মাধ্যমে তাদের পরিচয় প্রকাশ পায়। যেমন: মারমাদের সাংগ্রাই উৎসব, ত্রিপুরাদের বৈসুক উৎসব এবং সাঁওতালদের সোহরাই উৎসব তাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতিফলন।

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায়, নৃগোষ্ঠীগুলো তাদের সংস্কৃতি, ভাষা ও ঐতিহ্যের মাধ্যমে বিশ্ব সভ্যতাকে সমৃদ্ধ করেছে। কিন্তু আধুনিক বিশ্বায়ন ও সামাজিক পরিবর্তনের ফলে অনেক নৃগোষ্ঠী তাদের ঐতিহ্য হারানোর ঝুঁকিতে রয়েছে। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যেন তাদের ঐতিহ্য বজায় রাখতে পারে তাই নৃগোষ্ঠীগুলোর সংস্কৃতি সংরক্ষণ ও প্রচারে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ  গ্রহণ করা উচিত।  

Shihabur Rahaman
Shihabur Rahaman
Articles: 33