সুশাসন বলতে কি বুঝায়?
সুশাসন (Good Governance) হচ্ছে সার্বিক উন্নতির জন্য একটি দেশের সামাজিক এবং অর্থনৈতিক সম্পদের সুষম ব্যবস্থাপনার প্রয়োজনে ক্ষমতা প্রয়োগের পদ্ধতি। এটি এমন একটি রাষ্ট্র ব্যবস্থার প্রতিফলন যেখানে শাসক ও শাসিতের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় থাকবে, স্বাধীন বিচার বিভাগ থাকবে, গণতন্ত্র থাকবে, আইনের শাসন থাকবে, মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকবে, এবং সর্বোপরি স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা থাকবে।
সুশাসনের উদ্ভব ও গুরুত্ব: ৯০ এর দশকে জাতিসংঘ, ইউএনডিপিসহ বেশ কিছু সংস্থা সুশাসন সম্পর্কে চিন্তাভাবনা শুরু করে। ১৯৮৯ সালে সর্বপ্রথম বিশ্বব্যাংক এক সমীক্ষায় সুশাসন শব্দটি ব্যবহার করেছিল। পরবর্তীতে, বিশ্ব ব্যাংক ১৯৯২ সালে সুশাসনের সংজ্ঞা প্রদান করে যা ‘‘শাসন প্রক্রিয়া ও উন্নয়ন’’ নামক রিপোর্টে উল্লেখ করে। বর্তমানে, সুশাসন শব্দটি প্রায়শই জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো দ্বারা ব্যবহৃত হয়। সুশাসনের প্রধান লক্ষ্যগুলো হচ্ছে দুর্নীতি হ্রাস করা, সংখ্যালঘুদের মতামতকে বিবেচনায় নেওয়া, সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় নিপীড়িত মানুষের কণ্ঠস্বর শোনা এবং জনগনের প্রয়োজনে সক্রিয়ভাবে সাড়া দেওয়া।
আরো পড়ুন: প্লেটোর সাম্যবাদ তত্ত্বটি আলোচনা কর।
সুশাসনের প্রামাণ্য সংজ্ঞা: বিশ্বব্যাংকের মতে, উন্নয়নের জন্য একটি দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক সম্পদ ব্যবস্থাপনায় যে পদ্ধতিতে ক্ষমতা প্রয়োগ করা হয় তাকে সুশাসন বলে।
- UNDP এর মতে, ‘‘শাসন হলো অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক কর্তৃত্বের চর্চা যার মাধ্যমে একটি দেশের সকল স্তরের কার্যাবলী পরিচালনা করা যায়।”
- ম্যাককরনীর মতে, “সুশাসন বলতে রাষ্ট্রের সঙ্গে সুশীল সমাজের, সরকারের সঙ্গে শাসিত জনগণের, শাসকের সঙ্গে শাসিতের সম্পর্ক বোঝায়।’’
- G. Bilney-এর মতে, সুশাসন হচ্ছে একটি দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক সম্পদের কার্যকর ব্যবস্থাপনা যেটা উন্মুক্ত, স্বচ্ছ, জবাবদিহিতাপূর্ণ এবং ন্যায়সঙ্গত “।
- কফি আনান-এর মতে, “সুশাসন মানবাধিকার এবং আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধা নিশ্চিত করে, গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করে, জনপ্রশাসনের স্বচ্ছতা এবং সক্ষমতাকে প্রবর্তন করে।’’
সুশাসনের মূলনীতি ও বৈশিষ্ট্য: সুশাসন নিশ্চিত করার জন্য কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ নীতি ও বৈশিষ্ট্য পালন করতে হয়।
১. আইনের শাসন: সুশাসনের জন্য একটি দেশের আইন সবার জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য হতে হবে। নাগরিক, সরকারি কর্মকর্তা, এবং শাসক—সবারই আইন মেনে চলার বাধ্যবাধকতা থাকতে হবে। আইন যদি নিরপেক্ষভাবে কার্যকর না হয়, তবে সুশাসন নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।
২. স্বচ্ছতা: প্রশাসনের কাজ ও সিদ্ধান্ত জনগণের কাছে পরিষ্কার ও উন্মুক্ত থাকতে হবে। কোনো তথ্য গোপন না রেখে, জনগণকে রাষ্ট্রের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে অবগত করতে হবে, যাতে তারা সচেতন সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
৩. জবাবদিহিতা: সরকারের বিভিন্ন দফতর, প্রতিষ্ঠান ও কর্মকর্তাদের তাদের দায়িত্ব সম্পর্কে জনগণের কাছে জবাবদিহি থাকতে হবে। কোনো অনিয়ম বা দুর্নীতি হলে, তার জন্য উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা থাকতে হবে।
৪. কার্যকর ও দক্ষ প্রশাসন: একটি সরকার তখনই সুশাসন নিশ্চিত করতে পারে যখন প্রশাসন দক্ষতার সঙ্গে জনগণের চাহিদা পূরণে কাজ করে। সঠিক পরিকল্পনা, ন্যায়বিচার, এবং দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রশাসনের দক্ষতার পরিচায়ক।
৫. গণতন্ত্র ও অংশগ্রহণ: সুশাসনের জন্য জনগণের মতামতের মূল্যায়ন জরুরি। নির্বাচনের মাধ্যমে শাসক নির্বাচন, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, এবং মত প্রকাশের সুযোগ সুশাসনের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য।
আরো পড়ুন: সমাজকর্মের লক্ষ্য ও পাঠের গুরুত্ব
৬. দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা: যেখানে দুর্নীতি বেশি, সেখানে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা কঠিন। দুর্নীতি মুক্ত প্রশাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে রাষ্ট্রের উন্নয়ন ও জনসেবার মান বৃদ্ধি পায়।
৭. সমতা ও ন্যায়বিচার: সমাজের প্রতিটি নাগরিকের সমান অধিকার থাকতে হবে। ধনী-গরিব, নারী-পুরুষ, সংখ্যালঘু ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সবার প্রতি ন্যায়সঙ্গত আচরণ করতে হবে।
৮. দক্ষ অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা: একটি রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক সম্পদ ন্যায়সঙ্গত ও কার্যকরভাবে ব্যবহৃত হলে জনগণের জীবনমান উন্নত হয়। সরকারি বাজেট ব্যবস্থাপনা, ট্যাক্স নীতি, এবং জনসেবার কার্যকরতা সুশাসনের অংশ।
উপসংহার: সুশাসন প্রতিষ্ঠা ছাড়া একটি রাষ্ট্রের টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়। এটি নিশ্চিত করতে হলে আইনের শাসন, গণতন্ত্র, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, দুর্নীতি দমন ও কার্যকর প্রশাসন অপরিহার্য। সরকার, প্রশাসন এবং জনগণ একসঙ্গে কাজ করলে সুশাসন নিশ্চিত করা সম্ভব। একমাত্র সুশাসনের মাধ্যমেই একটি দেশ অর্থনৈতিক উন্নতি, সামাজিক স্থিতিশীলতা এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ বজায় রাখতে সক্ষম হবে।