১৯৭০ সালের নির্বাচনের ফলাফল ও গুরুত্ব

১৯৭০ সালের নির্বাচনের ফলাফল ও গুরুত্ব বর্ণনা কর।

ভূমিকা: ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন ছিল পাকিস্তানের প্রথম অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন, যা বাংলাদেশের স্বাধীনতার পথ প্রশস্ত করেছিল। তৎকালীন সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান প্রাদেশিক ও জাতীয় পরিষদের নির্বাচন আয়োজনের ঘোষণা দেন। পূর্ব পাকিস্তানে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ এবং পশ্চিম পাকিস্তানে জুলফিকার আলী ভুট্টোর নেতৃত্বে পাকিস্তান পিপলস পার্টি প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দল হিসেবে অংশগ্রহণ করে। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ তাদের ছয় দফা ভিত্তিক ইশতেহার উপস্থাপন করে, যা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের স্বাধিকার চেতনাকে প্রতিফলিত করে। অন্যদিকে, পিপলস পার্টি শক্তিশালী কেন্দ্র এবং ভারতবিরোধিতার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে। এ নির্বাচনই পরবর্তীতে পাকিস্তানের রাজনৈতিক অস্থিরতার সূচনা ঘটায় এবং বাংলাদেশ স্বাধীনতার দিকে এগিয়ে যায়।

আরো পড়ুনঃ মুক্তিযুদ্ধে নারীদের অবদান

১৯৭০ সালের নির্বাচনের ফলাফল

জাতীয় পরিষদে আওয়ামী লীগের বিজয়: জাতীয় পরিষদে ৩১৩টি আসনের মধ্যে ১৬৯টি আসন ছিল পূর্ব পাকিস্তানের জন্য। আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানে ১৬৭টি আসনে জয়লাভ করে। এই বিজয় বাঙালির একক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার প্রমাণ দেয়। এটি পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ঐক্যবদ্ধ রায়কে প্রতিফলিত করে।

পশ্চিম পাকিস্তানে পিপলস পার্টির প্রাধান্য: পাকিস্তান পিপলস পার্টি পশ্চিম পাকিস্তানের ১৩৮টি আসনের মধ্যে ৮৮টি আসনে জয়লাভ করে। তবে, তারা পূর্ব পাকিস্তানে একটি আসনও পায়নি। এটি পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক দূরত্বকে স্পষ্ট করে।

প্রাদেশিক পরিষদে আওয়ামী লীগের সাফল্য: প্রাদেশিক পরিষদের ৩০০টি সাধারণ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ২৮৮টি আসনে বিজয়ী হয়। সংরক্ষিত ১০টি মহিলা আসনসহ তাদের মোট আসন সংখ্যা দাঁড়ায় ২৯৮টি। এটি পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের নিরঙ্কুশ সমর্থন প্রমাণ করে।

ভোটারদের অংশগ্রহণ: এই নির্বাচনে প্রায় ৬৫% ভোটার অংশগ্রহণ করে, যা একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণের প্রমাণ। এটি পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতার বিকাশ ঘটায়।

ছয় দফার স্বীকৃতি: আওয়ামী লীগ তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে ছয় দফা দাবি উপস্থাপন করে। নির্বাচনে তাদের বিজয় প্রমাণ করে যে ছয় দফা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ন্যায্য দাবি।

পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন দলগুলোর ব্যর্থতা: পাকিস্তান মুসলিম লীগ (কাইয়ুম, কাউন্সিল, কনভেনশন), জামায়াতে ইসলামী এবং অন্যান্য ইসলামপন্থী দলগুলো সম্মিলিতভাবে মাত্র ৩৭টি আসন পায়। এই ব্যর্থতা পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনীতিতে পিপলস পার্টির আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে।

স্বাধীনতার আন্দোলনে ভূমিকা: নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ জয় বাঙালির মধ্যে স্বাধীনতার আন্দোলনের চেতনা জাগিয়ে তোলে। এটি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের জন্য ভিত্তি স্থাপন করে।

১৯৭০ সালের নির্বাচনের গুরুত্ব

আরো পড়ুনঃ যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে বঙ্গবন্ধুর পদক্ষেপসমূহ

জাতীয় ঐক্যের প্রতিফলন: নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ একত্রে আওয়ামী লীগের পক্ষে রায় প্রদান করে। এটি বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিজয়কে নিশ্চিত করে।

পাকিস্তান রাষ্ট্রের ভাঙনের সূচনা: নির্বাচনে দেখা যায়, পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণ একে অপরের প্রতি সমর্থন দেখায়নি। এটি পাকিস্তান রাষ্ট্রের একতা নষ্ট করে।

স্বায়ত্তশাসনের বৈধতা: নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয় প্রমাণ করে যে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের দাবি বৈধ এবং জনগণের সমর্থনপুষ্ট।

গণতান্ত্রিক চেতনার উত্থান: ১৯৭০ সালের নির্বাচন ছিল অবাধ ও নিরপেক্ষ। এটি পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে গণতান্ত্রিক চেতনার উত্থান ঘটায়।

পশ্চিম পাকিস্তানের কর্তৃত্ব হ্রাস: পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর দীর্ঘদিনের শোষণমূলক নীতির বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের রায় তাদের কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করে।

সংগ্রামী মনোভাব সৃষ্টি: নির্বাচনের পর ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা হস্তান্তর বিলম্বিত করলে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ প্রতিবাদে মুখর হয়। এটি অসহযোগ আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধের সূচনা ঘটায়।

স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম: ১৯৭০ সালের নির্বাচনের ফলাফলই ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার পথ সুগম করে।

পাকিস্তানের সংবিধান প্রণয়ন ব্যর্থতা: নির্বাচনের পর সংবিধান প্রণয়নের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। এটি পাকিস্তানের রাজনৈতিক সংকটকে আরও গভীর করে।

ইতিহাসের মোড় পরিবর্তন: ১৯৭০ সালের নির্বাচন পূর্ব পাকিস্তানকে একটি স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে গড়ে তোলে। এটি দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতির ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা।

আরো পড়ুনঃ বাংলাদেশের জনগণের নৃ-তাত্ত্বিক পরিচয়

উপসংহার: ১৯৭০ সালের নির্বাচন পাকিস্তানের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়। এই নির্বাচনের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ তাদের রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থান সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ করে। আওয়ামী লীগের বিজয় এবং ছয় দফার প্রতি জনগণের সমর্থন স্বাধীনতার আন্দোলনে অনুপ্রেরণা যোগায়। নির্বাচনের পর সামরিক শাসনের ষড়যন্ত্র ও দমননীতি জনগণকে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে বাধ্য করে। অবশেষে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন বাংলাদেশে পরিণত হয়। তাই, বলা যায়, ১৯৭০ সালের নির্বাচন বাংলাদেশের স্বাধীনতার পথকে প্রসারিত করে একটি জাতির বিজয়ের ভিত্তি স্থাপন করে।

Riya Akter
Riya Akter

আমি রিয়া আক্তার। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে অনার্স মাস্টার্স কমপ্লিট করেছি। ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে অনেকদিন যাবত কাজ করি। অবসর সময়ে মুভি দেখতে অনেক ভালো লাগে। ঘুরতে খুব বেশি পছন্দ করি। যে কাজের দ্বারা মানুষের ক্ষতি হবে এমন কাজ থেকে দূরে থাকি। সব সময় সৎ থাকার চেষ্টা করি।

Articles: 31