চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কি? [NU- 2020]
ভূমিকা: চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হল এক ধরণের ভূমি-রাজস্ব ব্যবস্থা। ১৭৯৩ সালে লর্ড কর্ণওয়ালিস বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যায় এই ভূমি-ব্যবস্থা চালু করেন। পরবর্তীকালে বারাণসী, উত্তর-পশ্চিম প্রদেশ ও মাদ্রাস প্রেসিডেন্সির কোনো কোনো অঞ্চলে এই ব্যবস্থা চালু করা হয়।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পটভূমি: চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ধারণা প্রথম ১৭৭২ সালে আলেকজান্ডার ডাও উত্থাপন করেন এবং পরে হেনরি পাত্তুলো, ড্যাক্রিস ও টমাস ল প্রমুখ এর পক্ষে যুক্তি দেন। ১৭৮৬ সালে কর্ণওয়ালিস ভারতে গভর্নর জেনারেল হয়ে আসার পর তিন বছর ধরে বাংলার ভূমি-রাজস্ব ব্যবস্থা নিয়ে গবেষণা করেন। ১৭৯০ সালে তিনি দেশীয় জমিদারদের সঙ্গে দশ বছরের জন্য ‘দশসালা বন্দোবস্ত’ চালু করেন এবং জানান, অনুমোদন পেলে এটি স্থায়ী হবে। শেষ পর্যন্ত ইংল্যান্ডের কর্তৃপক্ষ কর্ণওয়ালিসের মত সমর্থন করে এবং ১৭৯৩ সালে ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ ঘোষণা করা হয়।
প্রধান বৈশিষ্ট্য: ১৭৯৩ সালে লর্ড কর্নওয়ালিস কর্তৃক প্রবর্তিত চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ছিল ব্রিটিশ ভারতের বাংলা, বিহার, এবং উড়িষ্যাতে ভূমি রাজস্ব আদায়ের একটি ব্যবস্থা। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যনিম্নরূপ।
আরো পড়ুন: গ্রামীণ সমাজের প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট
১. স্থায়ী মালিকানা: এই ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা জমিদারদেরকে জমির স্থায়ী মালিক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এর ফলে তারা জমি বন্ধক, বিক্রয়, দান বা উত্তরাধিকারসূত্রে হস্তান্তর করতে পারতেন।
২. রাজস্ব আদায়ের নির্ধারিত পরিমান: জমিদারদেরকে প্রতি বছর নির্ধারিত পরিমাণ রাজস্ব (খাজনা) সরকারকে প্রদান করতে হত। এই রাজস্বের পরিমাণ জমির উর্বরতা ও আয়ের উপর নির্ধারণ করা হত।
৩. সরকারের ভূমিকা: চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের অধীনে সরকার কেবল রাজস্ব আদায়কারী হিসেবে কাজ করত। জমি ব্যবস্থাপনা, কৃষি উন্নয়ন, প্রজাদের অধিকার রক্ষা – এই বিষয়গুলোতে সরকারের তেমন কোন ভূমিকা ছিল না।
৪. জমিদারদের ক্ষমতা বৃদ্ধি: এই ব্যবস্থার মাধ্যমে জমিদারদের ক্ষমতা ও প্রভাব বৃদ্ধি পায়। তারা প্রজাদের উপর নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব প্রয়োগ করতে পারত।
৫. প্রজাদের শোষণ: জমিদাররা প্রজাদের কাছ থেকে অতিরিক্ত রাজস্ব আদায়, বিভিন্ন অবৈধ কর ধার্য, এবং শোষণের মাধ্যমে নিজেদের সম্পদ বৃদ্ধি করতে থাকে।
আরো পড়ুন: উপনিবেশবাদ কি?
৬. কৃষিক্ষেত্রের স্থবিরতা: চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে কৃষিক্ষেত্রের উন্নয়ন ব্যাহত হয়। জমিদারদের উদাসীনতা, প্রজাদের শোষণ, এবং ঋণের বোঝা কৃষিক্ষেত্রকে স্থবির করে দেয়।
৭. দারিদ্র্য বৃদ্ধি: ক্রমবর্ধমান শোষণ ও ঋণের বোঝার কারণে প্রজাদের দারিদ্র্যতা বৃদ্ধি পায়। অনেক কৃষক জমি ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।
৮. ঔপনিবেশিক শোষণ বৃদ্ধি: এই ব্যবস্থা ঔপনিবেশিক শোষণকে আরও তীব্র করে তোলে। ব্রিটিশ সরকার জমিদারদের মাধ্যমে ভারতীয় সম্পদ লুণ্ঠন করে।
উপসংহার: চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ছিল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শোষণের একটি হাতিয়ার। এই ব্যবস্থা জমিদারদের ক্ষমতা বৃদ্ধি, প্রজাদের শোষণ, এবং কৃষিক্ষেত্রের স্থবিরতার মাধ্যমে ভারতীয় সম্পদ লুণ্ঠনে কোম্পানি প্রশাসকদের সহযোগিতা করে।