গ্রামীণ বাংলাদেশের কৃষি ও অকৃষি কার্যক্রম আলোচনা কর।
ভূমিকা: বাংলাদেশের অর্থনীতি মূলত কৃষিভিত্তিক। দেশের গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রা কৃষির ওপর নির্ভরশীল। তবে আধুনিক উন্নয়নের ফলে গ্রামে কৃষির পাশাপাশি অকৃষি কার্যক্রমও বেড়েছে। কৃষি বলতে শস্য উৎপাদন, গবাদিপশু পালন, মৎস্য চাষ ও কৃষিসংশ্লিষ্ট অন্যান্য কাজ বোঝায়। আর অকৃষি কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে হস্তশিল্প, ক্ষুদ্র ব্যবসা, কারিগরি কাজ ও সেবা খাত। এই দুই ধরনের কার্যক্রম গ্রামীণ অর্থনীতিকে চালিত করে।
কৃষি কার্যক্রম
১. শস্য উৎপাদন: বাংলাদেশের গ্রামীণ জনগণের প্রধান জীবিকা শস্য উৎপাদন। ধান, গম, ভুট্টা, ডাল, আলু, তেলবীজ ইত্যাদি ফসল চাষ হয়। কৃষকদের প্রধানত বৃষ্টির পানি ও সেচের ওপর নির্ভর করতে হয়। বর্তমানে আধুনিক কৃষিপ্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ায় উৎপাদনও বেড়েছে। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ও বন্যা, খরা, লবণাক্ততা ইত্যাদি সমস্যা কৃষি উৎপাদনে বাধা সৃষ্টি করে।
২. শাক-সবজি ও ফল চাষ: ধান ও অন্যান্য প্রধান ফসলের পাশাপাশি শাক-সবজি ও ফল চাষ গ্রামে গুরুত্বপূর্ণ কৃষি কার্যক্রম। টমেটো, বেগুন, কুমড়া, মিষ্টি কুমড়া, শসা, পেঁপে, কলা, আম, কাঁঠাল, লিচু ইত্যাদি উৎপাদিত হয়। এগুলো গ্রামীণ জনগণের পুষ্টি চাহিদা পূরণ করে এবং বাজারে বিক্রি করে কৃষকরা আয় করতে পারে।
আরো পড়ুন: ধর্ম নিরপেক্ষ শিক্ষা কি?
৩. গবাদিপশু পালন: গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া, হাঁস-মুরগি পালন গ্রামীণ অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কৃষিকাজের জন্য গরু ও মহিষ ব্যবহৃত হয়। দুগ্ধ উৎপাদনের জন্য গরু পালন করা হয়। হাঁস-মুরগির ডিম ও মাংস বিক্রি করে কৃষকেরা অতিরিক্ত আয় করতে পারে। অনেক পরিবার গবাদিপশুর ওপর নির্ভরশীল।
৪. মৎস্য চাষ: বাংলাদেশ নদী ও খালবিলের দেশ হওয়ায় মৎস্য চাষ গ্রামীণ অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। চাষের মাধ্যমে রুই, কাতলা, মৃগেল, পাঙ্গাস, তেলাপিয়া ইত্যাদি মাছ উৎপাদিত হয়। এটি শুধু অর্থনীতিতে অবদান রাখে না, বরং গ্রামের মানুষের পুষ্টির চাহিদাও পূরণ করে। সরকার মৎস্য চাষের উন্নয়নে নানা পদক্ষেপ নিয়েছে।
৫. পোল্ট্রি খামার: গ্রামের অনেক কৃষক ও উদ্যোক্তা বাণিজ্যিকভাবে পোল্ট্রি খামার গড়ে তুলছে। এসব খামারে মুরগি, হাঁস, কোয়েল ও টার্কি পালন করা হয়। ডিম ও মাংস বিক্রি করে অর্থ উপার্জন সম্ভব। এটি নারীদের কর্মসংস্থানেও ভূমিকা রাখছে।
৬. কৃষিভিত্তিক ক্ষুদ্রশিল্প: গ্রামের অনেক মানুষ কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাত করে অর্থ উপার্জন করে। চাল ভাঙ্গানো, তেল নিষ্কাশন, গুড় তৈরি, মাছ শুকানো ইত্যাদি কাজ গ্রামের অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখে। এসব কার্যক্রম কৃষির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত।
৭. ফুল চাষ: বর্তমানে ফুল চাষ গ্রামে একটি লাভজনক কৃষি কার্যক্রম হিসেবে জনপ্রিয় হয়েছে। যশোর, ঝিনাইদহ, গাজীপুর, সাভারসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় গাঁদা, গোলাপ, রজনীগন্ধা ও গ্লাডিওলাসের চাষ হচ্ছে। শহরে এর ব্যাপক চাহিদা থাকায় কৃষকরা ভালো আয় করছে।
আরো পড়ুন: চাকমা সমাজের আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবন
৮. কৃষিজাত পণ্য বিপণন: গ্রামীণ কৃষকরা তাদের উৎপাদিত শস্য, ফল, শাক-সবজি, দুধ, মাছ, মাংস, ডিম স্থানীয় বাজারে বা শহরের পাইকারি বাজারে বিক্রি করে। কৃষিপণ্যের ন্যায্য দাম না পাওয়া একটি বড় সমস্যা। মাঝ посредহীনতা কমিয়ে সরাসরি কৃষকদের জন্য বাজার ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রয়োজন রয়েছে।
অকৃষি কার্যক্রম
৯. হস্তশিল্প ও কারুশিল্প: গ্রামের অনেক মানুষ হস্তশিল্প ও কারুশিল্পের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে। নকশিকাঁথা, মাটির পাত্র, বাঁশ ও বেতের সামগ্রী, শাড়ি, গামছা ইত্যাদি তৈরি হয়। নারীরা বিশেষভাবে এসব কাজে যুক্ত থাকে। এসব পণ্য স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদাসম্পন্ন।
১০. ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসা: গ্রামের দোকান, চায়ের দোকান, মুদি দোকান, কাপড়ের দোকান, ঔষধের দোকান ইত্যাদি ব্যবসা অনেক মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে। এ ধরনের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জন্য সহজ শর্তে ঋণ সুবিধা প্রয়োজন।
১১. গ্রামীণ পরিবহন: নৌকা, ভ্যান, রিকশা, মোটরসাইকেল ও ছোট ট্রাক দিয়ে গ্রামীণ এলাকায় পরিবহন ব্যবসা একটি গুরুত্বপূর্ণ কর্মসংস্থান তৈরি করেছে। কৃষিপণ্য পরিবহন, যাত্রী পরিবহন এবং মালামাল পরিবহন এই খাতে প্রধান কাজ।
১২. নির্মাণশ্রম: গ্রামে বাড়ি-ঘর নির্মাণ, রাস্তা নির্মাণ ও মেরামতের কাজে অনেক শ্রমিক কাজ করে। দিনমজুর হিসেবে কাজ করা গ্রামের নিম্নআয়ের মানুষের জীবিকার অন্যতম মাধ্যম।
১৩. সেলাই ও তাঁতশিল্প: গ্রামীণ নারীরা সেলাই কাজ ও তাঁতশিল্পের মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করে। টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ, নরসিংদী, পাবনাসহ বিভিন্ন এলাকায় তাঁতের কাপড় তৈরির ঐতিহ্য রয়েছে।
১৪. গ্রামীণ শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা: গ্রামের মানুষ শিক্ষকতা ও স্বাস্থ্যসেবার মাধ্যমে আয় করছে। সরকারি ও বেসরকারি বিদ্যালয়, কলেজ, মাদ্রাসা ও ক্লিনিকের মাধ্যমে শিক্ষিত তরুণরা জীবিকা নির্বাহ করছে।
আরো পড়ুন: The Caretaker Bangla Summary and Analysis
১৫. তথ্যপ্রযুক্তি ও ফ্রিল্যান্সিং: বর্তমানে ইন্টারনেট সুবিধার কারণে অনেক গ্রামীণ তরুণ-তরুণী ফ্রিল্যান্সিং, গ্রাফিক ডিজাইন, অনলাইন ব্যবসা ও ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। এটি গ্রামীণ অর্থনীতিতে নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে।
১৬. বিদেশে শ্রমিক প্রেরণ: গ্রামের অনেক মানুষ মধ্যপ্রাচ্য, মালয়েশিয়া, ইউরোপ ও অন্যান্য দেশে শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে যায়। রেমিট্যান্স দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তবে অনেকে প্রতারণার শিকার হয়, তাই নিরাপদ অভিবাসনের ব্যবস্থা জরুরি।
উপসংহার: বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতি কৃষি ও অকৃষি কার্যক্রমের ওপর নির্ভরশীল। কৃষি এখনও প্রধান জীবিকা হলেও অকৃষি খাত ধীরে ধীরে প্রসারিত হচ্ছে। সরকারের উন্নয়নমূলক পরিকল্পনা ও আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ালে গ্রামীণ অর্থনীতি আরও শক্তিশালী হবে এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।