আগরতলা মামলার কারণ ও ফলাফল বর্ণনা কর।
ভূমিকা: আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা ছিল ১৯৬৮ সালে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর এক প্রহসনমূলক ষড়যন্ত্র, যার লক্ষ্য ছিল পূর্ব পাকিস্তানে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে দমন করা। ছয় দফা আন্দোলনের মাধ্যমে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে যে গণজাগরণ শুরু হয়েছিল, তা রোধ করার জন্য পশ্চিম পাকিস্তানের আইয়ুব খান সরকার এই মামলা দায়ের করে। মামলাটি শেখ মুজিবসহ আরও ৩৫ জনের বিরুদ্ধে দায়ের করা হয় এবং তাদের বিরুদ্ধে পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনা হয়।
আরো পড়ুনঃ মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর অবদান
আগরতলা মামলার কারণসমূহ:
জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে দমন করা: ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে যে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা জন্মেছিল, তা ছয় দফা আন্দোলনের সময় আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এই জাতীয়তাবাদী আন্দোলন পাকিস্তানের শাসকদের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাই আইয়ুব সরকার ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা দমনের চেষ্টা করে।
ছয় দফা আন্দোলন স্তব্ধ করা: ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবের ছয় দফা দাবি পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের জন্য ছিল বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের মূল ভিত্তি। এই আন্দোলন ব্যাপক সমর্থন পায়, যা আইয়ুব খান সরকারকে ভীত করে তোলে। ছয় দফার আন্দোলনকে থামানোর জন্যই শেখ মুজিবকে প্রধান আসামি করে এই মামলা দায়ের করা হয়।
শেখ মুজিবকে রাজনীতি থেকে সরিয়ে দেয়া: শেখ মুজিব ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা এবং তার নেতৃত্বে গণজাগরণ চলছিল। আইয়ুব খান তাকে রাজনৈতিকভাবে নির্মূল করতে চেয়েছিলেন। এই ষড়যন্ত্র মামলার মাধ্যমে তার রাজনৈতিক জীবনের ইতি টানার পরিকল্পনা করা হয়েছিল।
শেখ মুজিবের জনপ্রিয়তায় আঘাত হানা: শেখ মুজিবকে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলায় জড়িয়ে পশ্চিম পাকিস্তানিদের কাছে তাকে বিশ্বাসঘাতক হিসেবে উপস্থাপন করতে চেয়েছিল আইয়ুব সরকার। এর মাধ্যমে তারা মুজিবের জনপ্রিয়তা কমিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে।
শোষণ অব্যাহত রাখা: পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী মনে করত, যদি শেখ মুজিবকে দমন করা না যায়, তবে তাদের অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক শোষণ বন্ধ হয়ে যাবে। তাই তারা শেখ মুজিবকে দমন করে পূর্ব পাকিস্তানে শাসন-শোষণ অব্যাহত রাখতে চেয়েছিল।
সেনাবাহিনীর সমর্থন বাড়ানো: মামলার আসামিদের মধ্যে অধিকাংশই ছিলেন পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর সদস্য। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী সেনাবাহিনির সমর্থন পেতে চেয়েছিল এবং বাঙালি সেনাদের বিশ্বাসঘাতক হিসেবে প্রমাণ করতে এই মামলা করা হয়েছিল।
আরো পড়ুনঃ মুক্তিযুদ্ধে নারীদের অবদান
আগরতলা মামলার ফলাফল:
জনমনে ক্ষোভের সৃষ্টি: আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা জনগণের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের জন্ম দেয়। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ বুঝতে পারে যে, এই মামলা আসলে তাদের কণ্ঠরোধ করার জন্য দায়ের করা হয়েছে। ফলে জনমনে প্রচণ্ড ক্ষোভ সৃষ্টি হয় এবং তারা শাসকগোষ্ঠীর প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করে।
জাতীয়তাবাদী চেতনার উত্থান: আগরতলা মামলা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনার আরও উন্মেষ ঘটায়। মামলাটিকে তারা তাদের স্বায়ত্তশাসনের দাবির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখেছিল। এর ফলে জনগণ আরও বেশি ঐক্যবদ্ধ হয়ে ওঠে।
শেখ মুজিবের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি: মামলার মাধ্যমে শেখ মুজিবকে রাজনৈতিকভাবে ধ্বংস করতে চাইলেও, এর উল্টো প্রভাব ঘটে। শেখ মুজিবকে জনগণ তাদের নায়ক হিসেবে দেখতে শুরু করে এবং তার জনপ্রিয়তা তীব্রভাবে বৃদ্ধি পায়। মামলার পর তিনি ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত হন।
গণঅভ্যুত্থানের সৃষ্টি: আগরতলা মামলার বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানে তীব্র গণআন্দোলন শুরু হয়। ছাত্রসমাজ ও সাধারণ মানুষ একত্রিত হয়ে আন্দোলনের মাধ্যমে ব্যাপক গণঅভ্যুত্থান সৃষ্টি করে, যা শেষ পর্যন্ত ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের রূপ নেয়।
মামলা প্রত্যাহার এবং শেখ মুজিবের মুক্তি: ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি, প্রবল গণআন্দোলনের মুখে আইয়ুব সরকার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়। একই দিনে শেখ মুজিবসহ সকল আসামিকে মুক্তি দেয়া হয়।
আইয়ুব খানের পতন: আগরতলা মামলাকে কেন্দ্র করে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন আরও তীব্র হয়। ১৯৬৯ সালের ২১ মার্চ, গণঅভ্যুত্থানের মুখে আইয়ুব খান পদত্যাগ করতে বাধ্য হন এবং ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা গ্রহণ করেন।
আরো পড়ুনঃ ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট গঠনের পটভূমি এবং ফলাফল
স্বাধীনতার ভিত্তি স্থাপন: আগরতলা মামলা এবং এর প্রতিক্রিয়ায় সৃষ্ট গণআন্দোলন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে স্বাধীনতার চেতনা আরও দৃঢ় করে। এই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়।
উপসংহার: আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা ছিল পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর একটি ষড়যন্ত্র, যার মাধ্যমে তারা পূর্ব পাকিস্তানের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে দমন করতে চেয়েছিল। তবে এই মামলা উল্টো প্রভাব ফেলে, কারণ এর মাধ্যমে বাঙালিরা আরও ঐক্যবদ্ধ হয়ে স্বাধীনতার পথে এগিয়ে যায়। মামলাটি শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বকে আরও সুসংহত করে এবং শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতার ভিত্তি স্থাপন করে।