বাংলাদেশের জনগণের নৃ-তাত্ত্বিক পরিচয়

বাংলাদেশের জনগণের নৃ-তাত্ত্বিক পরিচয় দাও।

ভূমিকা: বাংলাদেশের জনগণ বিভিন্ন নৃ-গোষ্ঠীর সমন্বয়ে গঠিত। এই দেশে বাঙালি জাতি প্রধান হলেও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি রয়েছে। ভৌগোলিক অবস্থান এবং ঐতিহাসিকভাবে এ অঞ্চলে বিভিন্ন জাতির আগমন ঘটেছে। বিভিন্ন যুগে বহিরাগত বিভিন্ন জাতি এখানে এসে মিলিত হয়েছে। ফলে, বাংলাদেশের জনগণ এক নৃ-তাত্ত্বিক বৈচিত্র্যের উদাহরণ। নিচে বাংলাদেশের জনগণের নৃ-তাত্ত্বিক পরিচয় বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হলো।

বাংলাদেশের জনগণের নৃ-তাত্ত্বিক পরিচয়:

বাঙালি জাতি: বাংলাদেশের বৃহত্তম জনগোষ্ঠী বাঙালি। এরা ইন্দো-আর্য জাতির অন্তর্গত। বাংলাদেশের প্রায় ৯৮% মানুষ বাঙালি, যারা মূলত বাংলা ভাষায় কথা বলে। এদের মধ্যে আর্য, দ্রাবিড় এবং অস্ট্রিক জাতির সংমিশ্রণ পরিলক্ষিত হয়। বাঙালিদের সংস্কৃতি, কৃষ্টি ও ঐতিহ্য বহু পুরনো এবং সমৃদ্ধ।

অস্ট্রিক জনগোষ্ঠী: অস্ট্রিক জাতি বাংলাদেশের প্রাচীনতম জনগোষ্ঠীগুলোর একটি। এদের মধ্যে সাঁওতাল, মুণ্ডা, ভূমিজ উল্লেখযোগ্য। তারা বাংলাদেশের উত্তরের বিভিন্ন এলাকায় বসবাস করে এবং নিজেদের স্বকীয় ভাষা ও সংস্কৃতি রয়েছে। অস্ট্রিক জনগোষ্ঠীর শিল্প, সংগীত ও ঐতিহ্য বাঙালি সমাজে গভীর প্রভাব ফেলেছে।

আরো পড়ুনঃ মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর অবদান

দ্রাবিড় জনগোষ্ঠী: দ্রাবিড়রা দক্ষিণ ভারতের প্রাচীন জাতি, যারা একসময় বাংলাদেশেও বসতি স্থাপন করেছিল। এদের মধ্যে ওরাওঁ ও পাহাড়িয়া জনগোষ্ঠী উল্লেখযোগ্য। যদিও এদের সংখ্যা কম, তবে তাদের অবদান বাংলাদেশের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশে অনস্বীকার্য।

মঙ্গোলয়েড জনগোষ্ঠী: মঙ্গোলয়েড জনগোষ্ঠীর প্রভাব পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে বেশি। চাকমা, মারমা, মণিপুরি এবং ত্রিপুরা এই গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। এদের স্বতন্ত্র ভাষা, ধর্ম ও ঐতিহ্য দেশের জাতিগত বৈচিত্র্যে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। এদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং উৎসব দেশের অন্যান্য জনগোষ্ঠীর মধ্যে ভিন্নতার ছাপ ফেলেছে।

নেগ্রিটো জনগোষ্ঠী: নেগ্রিটো জনগোষ্ঠী বাংলাদেশের আদিম জনগোষ্ঠী হিসেবে পরিচিত। তাদের চেহারার বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো খাটো দেহ, কালো গায়ের রং এবং চ্যাপ্টা নাক। বর্তমানে এদের সংখ্যা প্রায় বিলুপ্তির পথে। তবে ইতিহাসে তাদের অবদান উল্লেখযোগ্য। 

আর্য জাতি: আর্য জাতি ভারতের উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে এ অঞ্চলে আগমন করে। তাদের ভাষা ও কৃষি কার্যক্রম উন্নত ছিল। আর্যদের আগমনের ফলে বাঙালির ভাষা, সংস্কৃতি এবং জীবনযাপনের পদ্ধতিতে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। এরা বাঙালি জাতির সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

চাকমা ও মারমা: পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসকারী এই জাতিগোষ্ঠী বাংলাদেশের অন্যতম বৃহত্তম ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী। তাদের নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের অংশ। তাদের উৎসব ও রীতিনীতি দেশের সাংস্কৃতিক মেলবন্ধনে বিশেষ স্থান দখল করে।

গারো জনগোষ্ঠী: গারো সম্প্রদায় ময়মনসিংহ ও শেরপুর এলাকায় বসবাস করে। এরা মঙ্গোলয়েড গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। গারোদের নিজস্ব ভাষা, গান ও ঐতিহ্য তাদের পরিচিতির বিশেষ দিক, যা দেশের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে সমৃদ্ধ করে।

আরো পড়ুনঃ মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর অবদান

সাঁওতাল জনগোষ্ঠী: সাঁওতালরা অস্ট্রিক গোষ্ঠীর অন্তর্গত। তারা মূলত উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় বসবাস করে। সাঁওতালদের জীবনধারা ও সংস্কৃতি বাঙালি সমাজে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করেছে। তাদের ঐতিহ্যবাহী উৎসব ও সামাজিক রীতিনীতি দেশে স্বকীয় পরিচয় তৈরি করেছে।

ত্রিপুরা জাতি: ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী মূলত বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলে বাস করে। এরা মঙ্গোলয়েড গোষ্ঠীর অন্তর্গত এবং তাদের নিজস্ব ভাষা ও ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি রয়েছে। এদের জীবনধারা পার্বত্য এলাকার সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যে অবদান রেখেছে।

মণিপুরি জনগোষ্ঠী: মণিপুরি জাতি বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলে বাস করে। এরা মঙ্গোলয়েডদের একটি উপগোষ্ঠী এবং তাদের ঐতিহ্যবাহী নৃত্য ও সংগীত দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

বর্মণ জনগোষ্ঠী: বর্মণ জাতি বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে রয়েছে। এদের জীবনযাত্রা ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য দেশের ঐতিহ্যকে সমৃদ্ধ করেছে। এদের ভাষা ও সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান এখনও স্বতন্ত্রভাবে প্রচলিত।

তুর্কি ও আফগান: মধ্যযুগে তুর্কি ও আফগানদের আগমন ঘটে, যাদের প্রভাব বাংলাদেশের সমাজ ও সংস্কৃতিতে দেখা যায়। তারা বাংলার ইতিহাস, কৃষ্টি ও স্থাপত্যকলায় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনেন।

ইউরোপীয় প্রভাব: ইংরেজসহ অন্যান্য ইউরোপীয় জাতি বাংলায় এসে বসতি স্থাপন করে। এদের সংস্কৃতি ও রক্তধারা বাংলার সমাজে প্রভাব ফেলেছে, যা আজও বিভিন্ন আঙ্গিকে দৃশ্যমান।

খাসিয়া জাতি: খাসিয়া জাতি মেঘালয়ের একটি প্রাচীন গোষ্ঠী, যারা সিলেটের চা বাগান এলাকায় বসবাস করে। তাদের মঙ্গোলয়েড বৈশিষ্ট্য এবং স্বতন্ত্র ভাষা ও সংস্কৃতি রয়েছে, যা দেশের সংস্কৃতির অংশ।

আরো পড়ুনঃ ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট গঠনের পটভূমি এবং ফলাফল

উপসংহার: বাংলাদেশের জনগণের নৃতাত্ত্বিক পরিচয় একাধিক জাতিগোষ্ঠীর সংমিশ্রণে গঠিত। অস্ট্রিক, মঙ্গোলয়েড, দ্রাবিড়, নেগ্রিটো, আর্য এবং অন্যান্য জাতির অবদান দেশের সংস্কৃতিতে বিশেষ প্রভাব ফেলেছে। এই বৈচিত্র্য বাংলাদেশের সমাজকে বহুমাত্রিক ও অনন্য করে তুলেছে।

Riya Akter
Riya Akter

আমি রিয়া আক্তার। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে অনার্স মাস্টার্স কমপ্লিট করেছি। ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে অনেকদিন যাবত কাজ করি। অবসর সময়ে মুভি দেখতে অনেক ভালো লাগে। ঘুরতে খুব বেশি পছন্দ করি। যে কাজের দ্বারা মানুষের ক্ষতি হবে এমন কাজ থেকে দূরে থাকি। সব সময় সৎ থাকার চেষ্টা করি।

Articles: 31