বিবাহ বিচ্ছেদ কী? বিবাহ বিচ্ছেদের কারণ আলোচনা কর।
ভূমিকা: স্বামী স্ত্রীর মাঝে গঠিত বন্ধনই বিবাহ। একটি আদর্শ এবং সুশীল মানব সমাজ গঠনে বিবাহের ভূমিকা অগ্রগণ্য। বিবাহ একটি স্থায়ী বন্ধন। তবে বর্তমান সময়ে এটি বিভিন্ন কারণেএ সম্পর্ক ছিন্ন হয়। পৃথিবীর সূচনা লগ্ন থেকে বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য ঘটনা যেমন: শিল্পবিপ্লব, কৃষি বিপ্লব, দুদফা বিশ্বযুদ্ধ, যান্ত্রিক সভ্যতার উন্নয়ন তথা বিশ্বায়নের প্রভাবে বিবাহ ও বিবাহ বিচ্ছেদ উভয় প্রক্রিয়াই পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়।
বিবাহ: বিবাহ হল একটি সামাজিক বন্ধন বা বৈধ চুক্তি যার মাধ্যমে দু’জন মানুষের মধ্যে দাম্পত্য সম্পর্ক স্থাপিত হয়।
In The History of Human Marriage (1891), Edvard Westermarck defined marriage as “a more or less durable connection between male and female lasting beyond the mere act of propagation till after the birth of the offspring.”
এল এইচ মরগান এর মতে, “বিবাহ হচ্ছে আইন সংগত গণিকাবৃত্তি।”
ম্যালিনোস্কির মতে, “বিবাহ বলতে নরনারীর যৌন সম্পর্কের লাইসেন্স বা সামাজিক ছাড়পত্র বোঝায় না বরং এটি হলো পিতা-মাতা হওয়ার ছাড়পত্র।”
বিবাহ বিচ্ছেদ: বিবাহবিচ্ছেদ হল স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার বিদ্যমান সম্পর্কের বিলোপ সাধন। Webstar in his “third new international dictionary” says that “a legal dissolution in whole or in part of a marriage relation usually by a court or other body having competent authority.
বাংলাদেশের বিবাহ ও বিবাহ বিচ্ছেদের পরিবর্তনশীল রূপ: বাংলাদেশের সমাজে বিবাহ ও পরিবার সবসময় গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচিত। কিন্তু সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে অর্থনীতি, সমাজ, এবং প্রযুক্তির প্রভাবে এই দুইটি ক্ষেত্রেও অনেক পরিবর্তন এসেছে। বাংলাদেশের বিবাহ ও পরিবারের বর্তমান পরিবর্তনগুলো নিয়ে নিচে আলোচনা করা হলো:
আরো পড়ুন: প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রের শিক্ষা ব্যবস্থা
১. যৌথ পরিবার থেকে একক পরিবারে পরিবর্তন: আগে বেশিরভাগ পরিবার ছিল যৌথ, যেখানে একাধিক প্রজন্ম একসঙ্গে বাস করত। এখন শহরাঞ্চলে একক পরিবারের সংখ্যা বাড়ছে। চাকরি এবং আধুনিক জীবনের ব্যস্ততা এর প্রধান কারণ।
২. নারীর ভূমিকা ও কর্মসংস্থান: নারীরা এখন ঘরের কাজের পাশাপাশি চাকরি করে পরিবারের জন্য আর্থিক সহায়তা দিচ্ছেন। এই পরিবর্তনের ফলে পরিবারে নারী-পুরুষের ভূমিকার ভারসাম্য বেড়েছে এবং নারীর সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে।
৩. বিবাহের বয়স বৃদ্ধি: আগে মেয়েদের জন্য বিবাহের বয়স ছিল কম। এখন শিক্ষার প্রসার এবং আইনগত বিধিনিষেধের কারণে মেয়েদের ও ছেলেদের উভয়েরই বিবাহের বয়স বৃদ্ধি পেয়েছে। শিক্ষিত হতে চাওয়ার প্রবণতা এবং কর্মজীবনে স্থিতিশীলতার লক্ষ্য এই পরিবর্তনের প্রধান কারণ।
৪. প্রেমবিবাহের প্রবণতা: আগে পিতামাতার পছন্দে বিবাহ হতো। কিন্তু এখন তরুণ-তরুণীরা নিজের পছন্দে সঙ্গী নির্বাচন করছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং আধুনিক মানসিকতার কারণে প্রেমবিবাহের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।
৫. বিবাহ বিচ্ছেদ বৃদ্ধি: বর্তমানে বিবাহ বিচ্ছেদ বা আলাদা থাকার ঘটনা বেড়েছে। এর কারণ হতে পারে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, মানসিক অশান্তি, এবং সম্পর্কের সমস্যাগুলো। নারীরা এখন বিচ্ছেদের পরও স্বাবলম্বী হয়ে জীবনযাপন করতে পারছেন।
৬. বিয়ের আয়োজনের আধুনিকতা: আগে বিবাহ অনুষ্ঠান ছিল ঐতিহ্যনির্ভর। এখন কর্পোরেট আয়োজন, ডিজিটাল নিমন্ত্রণপত্র, এবং থিমেটিক বিবাহের প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এটি বিবাহকে সামাজিক প্রতিযোগিতার একটি অংশে পরিণত করেছে।
৭. সন্তান সংখ্যা হ্রাস: আগে পরিবারে অনেক সন্তান থাকত। এখন পরিবার পরিকল্পনা ও শিক্ষার কারণে দম্পতিরা কম সন্তানের দিকে মনোযোগ দিচ্ছেন। অনেক পরিবারে শুধু এক বা দুই সন্তানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে।
৮. বৃদ্ধাশ্রমের ব্যবহার বৃদ্ধি: যৌথ পরিবার কমে যাওয়ায় অনেক বৃদ্ধ বাবা-মা একা হয়ে পড়ছেন। তাদের জন্য বৃদ্ধাশ্রমের সংখ্যা বাড়ছে। যদিও এটি কিছু ক্ষেত্রে সামাজিক বিতর্কের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
৯. আন্তর্জাতিক বিবাহ বৃদ্ধি: অভিবাসন ও উচ্চশিক্ষার কারণে বিদেশে বসবাসকারী অনেক তরুণ-তরুণী আন্তর্জাতিক বিবাহ করছে। এটি নতুন সংস্কৃতির মেলবন্ধন ঘটালেও অনেক সময় চ্যালেঞ্জও তৈরি করে।
আরো পড়ুন: এরিস্টটলের মতে বিপ্লবের কারণ
১০. তথ্যপ্রযুক্তির প্রভাব: সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, অনলাইন ডেটিং অ্যাপ, এবং ভিডিও কলের মাধ্যমে সঙ্গী নির্বাচন ও সম্পর্ক তৈরি হচ্ছে। এটি প্রেম এবং বিবাহের পদ্ধতিকে সহজ করেছে, তবে কিছু ক্ষেত্রে সম্পর্কের মধ্যে দূরত্বও তৈরি করেছে।
১১. সমলিঙ্গ সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা: যদিও বাংলাদেশে সমলিঙ্গ বিবাহ আইনসিদ্ধ নয়, তবে এর প্রতি সচেতনতা ও আলোচনা বেড়েছে। সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা ধীরে ধীরে বাড়ছে।
১২. পিতৃত্ব ও মাতৃত্বের পরিবর্তন: বিবাহ বিচ্ছেদ বা ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তের কারণে একক পিতৃত্ব বা মাতৃত্বের সংখ্যা বেড়েছে। এটি পরিবার গঠনের নতুন দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করেছে।
১৩. ঘরের কাজের ভাগাভাগি: আগে ঘরের কাজ নারীদের উপর নির্ভরশীল ছিল। এখন পুরুষেরাও সন্তান লালনপালন ও ঘরের কাজে অংশ নিচ্ছেন। এটি পরিবারে সমতার একটি উদাহরণ।
১৪. আনুষ্ঠানিকতায় পরিবর্তন: বর্তমানে বিয়ের আয়োজন গুলো বেশ জাঁকজমকভাবেই উদযাপিত হয়। এতে প্রচুর অর্থ ব্যয় করে অনেক লোকজনের সমাগম ঘটানো হয়।
১৫. পরিবারের সাথে সম্পর্ক রক্ষা: প্রযুক্তির সাহায্যে দূরে থেকেও পরিবারের সদস্যরা সহজেই যোগাযোগ রাখতে পারছেন। মোবাইল ফোন এবং সামাজিক মাধ্যম এই পরিবর্তনের মূল কারণ।
১৬. সংস্কৃতির সঙ্গে আধুনিকতার মিশ্রণ: পরিবার ও বিবাহে আধুনিকতার প্রভাব বেড়েছে। তবে অনেক পরিবার এখনো তাদের ঐতিহ্য বজায় রাখার চেষ্টা করছে।
১৭.পাত্র-পাত্রী পছন্দের স্বাধীনতা: অতীতে সাধারণত পাত্রদের জন্য পাত্রী নির্বাচন করা হতো পরিবারের অভিভাবকদের দ্বারা। কিন্তু বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় পাত্র-পাত্রী উভয়ই তাদের নিজেদের সঙ্গী বাছাই করে থাকেন।
১৮. বিবাহ-বিচ্ছেদের পরিমাণ বৃদ্ধি: ব্যক্তিত্বের সংঘাত ও অতিরিক্ত ব্যক্তিগতভাবে স্বাধীন হওয়ার প্রবণতা স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করছে। তাই বর্তমানে অতীতের তুলনায় বিবাহবিচ্ছেদের পরিমাণ ঘটছে বেশি।
আরো পড়ুন: এরিস্টটলের মতে বিপ্লবের কারণ
১৯. বিবাহ বহির্ভূত যৌন সম্পর্ক: বর্তমানে স্বামী-স্ত্রী উভয় ই যৌন সম্পর্কের ক্ষেত্রে স্বাধীনতা ভোগ করে থাকেন। এর ফলে অনেকেই অনেক সময় বিবাহ বহির্ভূত যৌন সম্পর্ক প্রতিস্থাপন নিজেদের স্বাধীনতার প্রকাশ বলে মনে করেন।
উপসংহার: উপরোক্ত আলোচনা থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, আধুনিকতার সাথে মানিয়ে নিতে বর্তমান সমাজে বিবাহ ও বিবাহ বিচ্ছেদ উভয় প্রক্রিয়াই অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। এই পরিবর্তনগুলি যেমন ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে, তেমনই চ্যালেঞ্জও তৈরি করছে। নতুন ধারা অনুযায়ী পরিবার ও সমাজে ভারসাম্য রক্ষা করাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।