চাকমা সমাজের আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবন

বাংলাদেশের চাকমা সমাজের আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবন এর বর্ণনা দাও। অথবা, চাকমা এথনিক গোষ্ঠীর আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবন আলোচনা করা। [NU- 2015, 19, 21] ★★★

আদিবাসী জনগোষ্ঠী বাংলাদেশের বহুমুখী সংস্কৃতির অপরিহার্য অংশ। চাকমা ও গারো এদেশের  দুটি উল্লেখযোগ্য আদিবাসী সম্প্রদায় যারা তাদের অনন্য সংস্কৃতি, রীতিনীতি, এবং জীবনধারার জন্য অধিক পরিচিত।  চাকমারা মূলত পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, এবং বান্দরবান জেলায় বসবাস করে।  পাহাড়ি এলাকায় তাদের বসবাসের কারণে তাদের জীবনধারা অনেকাংশে পাহাড়ের উপর নির্ভরশীল।

বাংলাদেশের চাকমা উপজাতির আর্থ-সামাজিক জীবনধারাঃ 

চাকমা হল বাংলাদেশে অন্যান্য উপজাতিদের মধ্যে  প্রগতিশীল উপজাতি ।   চাকমারা পার্বত্য চট্টগ্রাম, বান্দরবান ও রাঙ্গামাটিতে   বাস করে। নিম্নে চাকমা উপজাতির   আর্থ-সামাজিক  বা সাংস্কৃতিক জীবনধারা আলোচনা করা হলো-

(১) চাকমা নামকরণঃ বয়স্ক শিক্ষিত চাকমারা নিজেদের চাকমা নামে পরিচয় স্বাচ্ছন্দ বোধ করেন।  নৃ-তাত্ত্বিক রিজলের মতে, ব্রম্ভাষার সাক বা সেক জাতি থেকে চাকমাদেরউপজাতির উৎপত্তি হয়েছে । ক্যাপ্টেন লুহন বলেন, “The name chakma, probably has been given by the inhabitants of Chittagong.”

(২) উৎপত্তি ও ইতিহাসঃ মগদের মতে, চাকমারা মুঘলদের বংশধর। এককালে মুঘলগণ আরাকানের হাতে পরাজিত হলে আরাকান রাজ তাদের বন্দী করে আরাকানী নারীদের সাথে বিবাহ দেন। এসব মুঘল সৈন্যের ঔরষে- আরাকানী নারীদের গর্ভে যে জাতির উদ্ভব হয়েছিল তারাই সাক বা সেক। চাকমা পুরাকাহিনীতে বর্ণিত হয়েছে, চাকমারা চমক নগরে বাস করতাে। এক চাকমা রাজপুত বার্মার আরাকানের কিছু অঞ্চল নবম থেকে চতুর্দশ শতাব্দী পর্যন্ত শাসন করে। অতঃপর স্থানীয় আরাকানীদের দ্বারা বিতাড়িত হয়ে চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে বসবাস শুরু করে।

(৩) চাকমা জনসংখ্যাঃ ১৯৯১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রায় ৩,৪০,০০০ চাকমা বসবাস করতেন, যা দেশের মোট আদিবাসী জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক। সর্বশেষ ২০২২ সালের জনশুমারি অনুযায়ী, দেশের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মোট জনসংখ্যা ১৬,৫০,১৫৯ জন। তবে, বিভিন্ন আদিবাসী নেতাদের মতে, প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়ে বেশি হতে পারে।

আরো পড়ুন: সমাজকর্মের মৌলিক পদ্ধতি তিনটি পরস্পর সম্পর্কযুক্ত

(৪) ভাষাঃ   চাকমারা অন্যান্য উপজাতিদের থেকে চাকমাদের ভাষা স্বতন্ত্র। চাকমারা বর্তমানে একটি বাংলা উপভাষায় কথা বলে, যাকে তারা চাকমা বা চাঙমা ভাষা বলে। চাকমারা তিব্বত-বর্মী  ভাষায় কথা বলে।  তবে বাংলা ভাষাও তাদের মধ্যে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়।

(৫) চাকমাদের ধর্মঃ অধিকাংশ চাকমা বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী। বৌদ্ধধর্ম প্রধান হলেও চাকমাদের মধ্যে হিন্দুধর্ম, খ্রিস্টধর্ম অনুসারী ও রয়েছে। গ্রাম্য এলাকায় বৌদ্ধ মন্দির দেখা  যায়। তাদের মধ্যে দু’ধরনের বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। তারা গঙ্গা পুজা ও লক্ষী পূজা করে।  গােজেন নামক ঈশ্বরকে তারা খুবই ভক্তিশ্রদ্ধা করে। তাদের প্রধান ধর্মগ্রন্থ ১৭টি।

(৬) চাকমাদের নরগােষ্ঠিগত পরিচয়ঃ চাকমাদের সাথে চীনা মঙ্গোলয়েডদের যথেষ্ট মিল লক্ষ্য করা যায়। তাদের উচ্চতা মাঝারি থেকে বেটে। দৈহিক গড়নে এরা শক্তিশালী। গায়ে লােমের স্বল্পতা, চ্যাপ্টা নাক ও ক্ষুদ্র চোখ লক্ষ্য করা যায়।

(৭) চাকমা পরিবারঃ চাকমা পরিবার পিতৃতান্ত্রিক। চাকমা পরিবারে সম্পত্তি বা বংশ পরিচয় পিতা থেকে পুত্রে বর্তায়। চাকমারা সাধারণত এক বিবাহভিত্তিক অনু পরিবার গঠন করে।

(৮) বিবাহ প্রথাঃ বিবাহের ব্যাপারে চাকমা সমাজে কিছু কুসংস্কার লক্ষ্য করা যায়। তাদের মধ্যে নিজ বংশের সাত পরুষের মধ্যে বিবাহ নিষিদ্ধ। তাদের সমাজে অন্তঃবিবাহ ও বহিঃবিবাহ প্রচলিত। চাকমা সমাজে বহু স্ত্রী বিবাহ এবং বিধবা বিবাহ অনুমােদিত।

(৯) বিবাহ বিচ্ছেদঃ চাকমা সমাজে বিবাহ বিচ্ছেদ কদাচিৎ ঘটে। বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য গ্রাম্য সালিশ ডাকতে হয়।

(১০) চাকমাদের পােশাক পরিচ্ছদঃ চাকমা পুরুষদের পােশাক হলাে ধুতি, কোট, কখনও মাথায় পাগড়ি। মেয়েরা সাধারণত কোমর থেকে হাঁটুর নিচ পর্যন্ত স্কার্ট, বুকে ব্রেস্ট ক্লোথ এবং মাথায় সাদা শিরস্ত্রাণ পরিধান করে।

(১১) চাকমাদের উৎসবঃ বিজু ও মর্দারের পানাথার চাকমাদের প্রধান উৎসব। এ ছাড়া বিভিন্ন উদ্দেশ্যসাধনের জন্য চাকমারা ঈশ্বরের পূজা করে থাকে।

(১২) নেতৃত্বঃ চাকমা সমাজে আদমের নেতৃত্বে কারবারী, গ্রামের নেতৃত্বে হেডম্যান ও চাকমা সার্কেলের নেতৃত্বে থাকেন রাজা।

(১৩) শিক্ষাঃ অন্যান্য উপজাতির তুলনায় চাকমারা বেশি শিক্ষিত। তারা বাংলা ও ইংরেজিতে শিক্ষা গ্রহণ করছে। ফলে আজকাল বহু চাকমা সরকারি উচ্চপদে নিয়ােজিত।

আরো পড়ুন: এরিস্টটলের মতে বিপ্লবের কারণ

(১৪) চাকমা অর্থনীতিঃ ঐতিহ্যগতভাবে চাকমারা জুম চাষের ওপর নির্ভরশীল। তারা বর্তমানে ব্যক্তি মালিকানায় হাল-চাষ পদ্ধতি শিখতে শুরু করছে। তারা রাবার ওক কাঠের গাছের চাষ করে। সমতল নিম্ন ভূমিতে ধান চাষ করে। বর্তমানে তাদের অনেকেই মােরগ, মুরগী ও শুকর পালন করে।

(১৫) অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াঃ চাকমা সমাজে মৃতদেহ পােড়ানাে হয়। তবে বুধবারে মৃতদেহ পােড়ানাে নিষিদ্ধ। সাত বছরের কম বয়সীদের কবর দেয়া হয়। মৃত্যুর সাতদিন পর সাতদিন্যা নামক একটি অনুষ্ঠান পালন করা হয়। এ অনষ্ঠানে মদ, খাদ্য প্রভৃতি দ্রব্য মৃতের আত্মার উদ্দেশে উৎসর্গ করা হয়।

পরিশেষে বলা যায় যে, আধুনিক বিজ্ঞান ও সভ্যতার স্পর্শ সর্বত্র লাগলেও চাকমাদের প্রাচীন সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের অনেক কিছু এখনও বর্তমান।  তবে চাকমাদের সমৃদ্ধ সংস্কৃতি জেমনঃ নিজস্ব সঙ্গীত, নৃত্য, এবং ঐতিহ্য রয়েছে। তারা ধীরে ধীরে আধুনিক সভ্যতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। 

Shihabur Rahaman
Shihabur Rahaman
Articles: 33