মার্ক্সীয় মতানুসারে সমাজ বিকাশের বিভিন্ন পর্যায়সমূহ আলোচনা কর।

মার্ক্সীয় মতানুসারে সমাজ বিকাশের বিভিন্ন পর্যায়সমূহ আলোচনা কর।

ভূমিকাঃ কার্ল মার্ক্স তাঁর ঐতিহাসিক বস্তুবাদ তত্ত্বে সমাজ বিকাশকে একটি ধারাবাহিক ও বৈপ্লবিক প্রক্রিয়া হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তাঁর মতে, উৎপাদন পদ্ধতির পরিবর্তন ও শ্রেণিসংঘর্ষ সমাজের কাঠামো বদলে দেয়। সমাজ বিকাশের পাঁচটি প্রধান পর্যায় হলোঃ প্রাচীন সাম্যবাদী সমাজ, দাসপ্রথা, সামন্তবাদ, পুঁজিবাদ এবং সমাজতন্ত্র বা সাম্যবাদ। প্রতিটি পর্যায় একটি নির্দিষ্ট অর্থনৈতিক ভিত্তি এবং সামাজিক সম্পর্কের উপর প্রতিষ্ঠিত। নিচে প্রতিটি পর্যায়ের বিশদ ব্যাখ্যা দেওয়া হলোঃ

১. প্রাচীন সাম্যবাদী সমাজ (Primitive Communism): প্রাচীন সাম্যবাদী সমাজ মানব সভ্যতার প্রাথমিক ধাপ, যেখানে মানুষ স্বাভাবিক সম্পদ ও পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে জীবনযাপন করত। প্রাচীন সাম্যবাদী সমাজের বৈশিষ্ট্যসমূহঃ

আরো পড়ুনঃ মুক্তিযুদ্ধে নারীদের অবদান

i) উৎপাদন পদ্ধতিঃ এই পর্যায়ে মানুষ শিকার, মাছ ধরা, ফল সংগ্রহ ইত্যাদির মাধ্যমে জীবনধারণ করত। যন্ত্রপাতি বা উন্নত প্রযুক্তির অনুপস্থিতি থাকায় উৎপাদন ছিল সীমিত।

ii) সম্পত্তিঃ ব্যক্তিগত সম্পত্তির ধারণা ছিল না। সবকিছু গোষ্ঠীর সদস্যদের মধ্যে ভাগাভাগি করা হতো।

iii) সামাজিক সম্পর্কঃ শ্রেণি বিভাজন ছিল না। নারী ও পুরুষের ভূমিকা ছিল সমান, কারণ উভয়েই জীবিকার জন্য প্রয়োজনীয় কাজ করত।

iv) উদাহরণঃ আদিম গোষ্ঠীগত সমাজ বা উপজাতি।

v) সীমাবদ্ধতাঃ উৎপাদনশীলতার অভাব এবং সম্পদের সীমাবদ্ধতা সমাজের দ্রুত উন্নয়নে বাধা সৃষ্টি করত।

২. দাসপ্রথা ভিত্তিক সমাজ (Slave Society): প্রাচীন সাম্যবাদী সমাজ ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে দাসপ্রথার সূচনা করে। এই পর্যায়ে ব্যক্তি মালিকানার ধারণা এবং শক্তিশালী মানুষের দাসদের উপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। দাসপ্রথা ভিত্তিক সমাজের বৈশিষ্ট্যসমূহঃ 

i) উৎপাদন পদ্ধতিঃ কৃষি ও পশুপালন শুরু হয়। এই সময়ে মানুষ ক্রীতদাসদের শ্রম ব্যবহার করে উৎপাদন বৃদ্ধি করে।

ii) সম্পত্তিঃ ব্যক্তিগত সম্পত্তির উদ্ভব ঘটে। জমি, দাস এবং অন্যান্য সম্পদ ছিল ধনী ও ক্ষমতাশালীদের হাতে।

iii) সামাজিক সম্পর্কঃ সমাজ দাস এবং দাসমালিক শ্রেণিতে বিভক্ত ছিল। দাসমালিকরা দাসদের উপর শোষণ চালিয়ে সম্পদ আহরণ করত।

iv) উদাহরণঃ মিশর, গ্রিস, এবং রোমান সাম্রাজ্যের সমাজব্যবস্থা।

v) সীমাবদ্ধতাঃ দাসপ্রথার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ এবং অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষ সমাজের ধ্বংসের কারণ হয়।

৩. সামন্তবাদী সমাজ (Feudal Society): দাসপ্রথার পতনের পর সামন্তবাদী সমাজের উদ্ভব ঘটে। এই সমাজ ছিল জমির মালিকানাভিত্তিক, যেখানে সামন্তপ্রভুরা ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল। সামন্তবাদী সমাজের বৈশিষ্ট্যসমূহঃ

i) উৎপাদন পদ্ধতিঃ কৃষি ছিল প্রধান উৎপাদন ক্ষেত্র। জমির মালিক সামন্তপ্রভুরা, আর কৃষকরা তাঁদের অধীনস্থ হয়ে কাজ করত।

আরো পড়ুনঃ বাংলাদেশের জনগণের নৃ-তাত্ত্বিক পরিচয়

ii) সম্পত্তিঃ জমি ছিল সম্পদের প্রধান উৎস। সামন্তপ্রভুরা জমির মালিক, এবং ভৃত্যরা জমি চাষ করত।

iii) সামাজিক সম্পর্কঃ সামন্তপ্রভু ও কৃষকদের মধ্যে শোষণমূলক সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল। কৃষকরা সামন্তপ্রভুর জন্য শ্রম দিত এবং বিনিময়ে জীবনধারণের ন্যূনতম সুযোগ পেত।

iv) উদাহরণঃ মধ্যযুগীয় ইউরোপের ফিউডাল সমাজ।

v) সীমাবদ্ধতাঃ নগরায়ণ এবং বাণিজ্যের বিকাশ সামন্তবাদকে ধ্বংস করে দেয়।

৪. পুঁজিবাদী সমাজ (Capitalist Society): সামন্তবাদ ধ্বংস হয়ে পুঁজিবাদী সমাজ গড়ে ওঠে। শিল্প বিপ্লব পুঁজিবাদ প্রতিষ্ঠার প্রধান ভিত্তি। এই সমাজব্যবস্থা ব্যক্তি মালিকানার উপর প্রতিষ্ঠিত। পুঁজিবাদী সমাজের বৈশিষ্ট্যসমূহঃ

i) উৎপাদন পদ্ধতিঃ শিল্প বিপ্লবের মাধ্যমে উৎপাদন ব্যবস্থা আধুনিক হয়ে ওঠে। কলকারখানা এবং মেশিনভিত্তিক উৎপাদনের প্রচলন ঘটে।

ii) সম্পত্তিঃ উৎপাদনের উপকরণ ব্যক্তিগত মালিকানাধীন ছিল।

মুনাফা অর্জনই ছিল মূল লক্ষ্য।

iii) সামাজিক সম্পর্কঃ সমাজে প্রধান দুটি শ্রেণি গড়ে ওঠেঃ

  • বুর্জোয়া (মালিক): কারখানা ও উৎপাদনের উপকরণের মালিক।
  • প্রলেতারিয়েত (শ্রমিক): যারা তাঁদের শ্রম বিক্রি করে। শ্রমিকশ্রেণি চরম শোষণের শিকার হয়।

iv) উদাহরণঃ আধুনিক শিল্পসমাজ।

v) সীমাবদ্ধতাঃ শ্রমিকশ্রেণির মধ্যে অসন্তোষ ও শোষণের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ পুঁজিবাদের পতন ডেকে আনবে।

৫. সমাজতান্ত্রিক বা সাম্যবাদী সমাজ (Socialist/Communist Society): মার্ক্সের মতে, শ্রেণিসংঘর্ষের চূড়ান্ত ফলস্বরূপ সমাজতন্ত্রের উদ্ভব ঘটে। এই পর্যায়ে শ্রেণিহীন ও শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়। সমাজতান্ত্রিক বা সাম্যবাদী সমাজের  বৈশিষ্ট্যসমূহঃ

i) উৎপাদন পদ্ধতিঃ উৎপাদনের উপকরণ থাকে জনগণের হাতে। উৎপাদনের ফল সবার মধ্যে সমভাবে ভাগ করা হয়।

ii) সম্পত্তিঃ ব্যক্তিগত সম্পত্তি বিলুপ্ত হয়। জমি, কলকারখানা এবং অন্যান্য সম্পদ জনগণের যৌথ মালিকানায় থাকে।

iii) সামাজিক সম্পর্কঃ শ্রেণিহীন সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়। মানুষের মধ্যে সাম্য ও ভ্রাতৃত্ববোধের বিকাশ ঘটে।

iv) লক্ষ্যঃ সামাজিক শোষণ নির্মূল এবং সবার জন্য সমান সুযোগ।

v) বাস্তবায়নঃ সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার জন্য পুঁজিবাদকে ধ্বংস করতে হবে। একটি বিপ্লবের মাধ্যমে এই সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠবে। মার্ক্সের দৃষ্টিতে সমাজ বিকাশের চালিকা শক্তি

vi) উৎপাদন সম্পর্ক ও শক্তির সংঘর্ষঃ প্রতিটি সমাজের ভিত্তি হলো তার উৎপাদন পদ্ধতি। উৎপাদন পদ্ধতির পরিবর্তন শ্রেণিসংঘর্ষ সৃষ্টি করে।

আরো পড়ুনঃ যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে বঙ্গবন্ধুর পদক্ষেপসমূহ

vii) শ্রেণিসংঘর্ষঃ প্রভু ও শোষিত শ্রেণির মধ্যে সংঘর্ষ সমাজ বিকাশের প্রধান শক্তি।

viii) বৈপ্লবিক পরিবর্তনঃ শ্রেণিসংঘর্ষের মাধ্যমে নতুন সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়।

উপসংহারঃ কার্ল মার্ক্সের মতে, সমাজ বিকাশ একটি ধারাবাহিক ও যৌক্তিক প্রক্রিয়া। প্রতিটি সমাজব্যবস্থা তার নিজস্ব সীমাবদ্ধতার কারণে ধ্বংস হয় এবং নতুন ব্যবস্থার জন্ম দেয়। সর্বশেষ ধাপে, শ্রেণিহীন সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে, যেখানে শোষণ, অসাম্য, এবং দারিদ্র্যের অবসান ঘটবে। এই তত্ত্ব সমাজ পরিবর্তন ও উন্নয়নের একটি গতিশীল মডেল প্রদান করে।

Sima Khatun
Sima Khatun

আমি সিমা খাতুন। আমি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি বিষয়ে অনার্স ও মাস্টার্স
কমপ্লিট করেছি। ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে আমার অনেক অভিজ্ঞতা রয়েছে। আমি শিক্ষার্থীদের ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য সহজভাবে শেখাতে কাজ করি। শিক্ষার্থীদের সাহিত্যের প্রতি আগ্রহ বাড়ানোই আমার লক্ষ্য।

Articles: 128