মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সংজ্ঞা ও বাংলায় মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উদ্ভব ও বিকাশ
ভূমিকা: বাংলাদেশের সমাজে মধ্যবিত্ত শ্রেণি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ব্রিটিশ শাসনামলে ইংরেজি শিক্ষার প্রসারের মাধ্যমে এদেশের সমাজব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন ঘটে। ঐতিহ্যবাহী সমাজ কাঠামো ভেঙে নতুন এক সামাজিক শ্রেণির উদ্ভব হয়। এভাবেই মধ্যবিত্ত শ্রেণির উত্থান শুরু হয়, যা দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক, ও রাজনৈতিক অগ্রগতিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে।
মধ্যবিত্ত শ্রেণি: সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্য
মধ্যবিত্ত শ্রেণির সংজ্ঞা: মধ্যবিত্ত শ্রেণি বলতে সাধারণত উচ্চশ্রেণি ও নিম্নশ্রেণির মধ্যবর্তী সামাজিক শ্রেণিকে বোঝায়। এ শ্রেণির মধ্যে রয়েছে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, পেশাজীবী, বুদ্ধিজীবী, দক্ষ কারিগর, ধনী কৃষক, বেতনভুক্ত কর্মচারী ও মানসিক শ্রমজীবী। এদের প্রধান লক্ষ্য স্বাধীনতা অর্জন এবং কর্মসংস্থানের অধিকার নিশ্চিত করা। তবে মধ্যবিত্ত শ্রেণি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই উৎপাদনমূলক কাজের সঙ্গে সরাসরি জড়িত থাকে না।
বিশেষজ্ঞদের মতামত
ড. নাজমুল করিম বলেছেন, “মাঝারি আয়ের লোকদের মধ্যবিত্ত বলা হয়। সামাজিক মর্যাদার দিক থেকেও তাদের মধ্যবিত্ত হিসেবে গণ্য করা হয়।”
গ্রেটন বলেছেন, “যে শ্রেণির জন্য অর্থ বা মুদ্রা জীবনের প্রধান নিয়ামক, তারা মধ্যবিত্ত।”
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এরিস্টটল তাঁর গ্রন্থ Politics-এ উল্লেখ করেন, “যখন মধ্যবিত্ত শ্রেণি সমাজের নিয়ন্ত্রক হয়, তখন সমাজ সবচেয়ে স্থিতিশীল থাকে।”
বাংলায় মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব ও বিকাশ
১. ইংরেজি শিক্ষা প্রবর্তন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশ: ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠার পর ইংরেজি শিক্ষার প্রসার ঘটে। ১৭৮১ সালে কলকাতা মাদ্রাসা এবং ১৭৯২ সালে বেনারসে সংস্কৃতি কলেজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শিক্ষাব্যবস্থার আধুনিকায়ন শুরু হয়। ১৮৩৫ সালে লর্ড বেন্টিং ইংরেজি শিক্ষা চালুর সুপারিশ করেন। এর ফলে এদেশে ইংরেজি ভাষাভিত্তিক শিক্ষিত এক মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশ ঘটে।
২. চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ও ভূমি সংস্কার: ১৭৯৩ সালে লর্ড কর্নওয়ালিস চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তন করেন। এর মাধ্যমে জমিদারি ব্যবস্থার সৃষ্টি হয়। এ ব্যবস্থার ফলে নতুন এক ভূমিনির্ভর মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব ঘটে।
আরো পড়ুনঃ Tintern Abbey Bangla Summary
৩. হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশ: ইংরেজি শিক্ষার প্রসারে হিন্দুরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। মুসলমানরা ইংরেজি শিক্ষাকে ধর্মবিরোধী বলে মনে করলেও হিন্দুরা তা গ্রহণ করে নিজেদের উন্নয়নের পথে এগিয়ে যায়। কলকাতার ধনী হিন্দু বণিক সম্প্রদায় ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ করে মধ্যবিত্ত শ্রেণি গড়ে তোলে।
৪. কলকাতাকেন্দ্রিক মধ্যবিত্ত শ্রেণি: ব্রিটিশ শাসনের সময় কলকাতায় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশ ঘটে। ইংরেজি শিক্ষার প্রসারের ফলে এই শহরটি মধ্যবিত্তদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের কেন্দ্রস্থল হয়ে ওঠে।
৫. মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশ: ব্রিটিশদের শাসনব্যবস্থাকে মুসলমানরা প্রথমে ‘দারুল হরব’ বলে মনে করত এবং ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণে বিরূপ মনোভাব দেখায়। তবে নবাব আব্দুল লতিফ, স্যার সৈয়দ আহমদ খান, এবং সৈয়দ আমীর আলীর মতো ব্যক্তিদের প্রচেষ্টায় মুসলমানরা ইংরেজি শিক্ষার প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠে। ১৮৬৩ সালে মুসলিম সাহিত্য সমিতি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মুসলিম শিক্ষিত শ্রেণির উত্থান শুরু হয়।
৬. মুঘল আমলের মধ্যবিত্ত শ্রেণি: মুঘল আমলে ভূমিনির্ভর অর্থনীতি ছিল। এ সময় মধ্যস্বত্বভোগী একটি শ্রেণি গড়ে ওঠে, যা পরবর্তীতে মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশে ভূমিকা রাখে।
মধ্যবিত্ত শ্রেণির ভূমিকা ও প্রভাব
সামাজিক উন্নয়নে ভূমিকা: মধ্যবিত্ত শ্রেণি সামাজিক মূল্যবোধ, শিক্ষার প্রসার, এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। ব্রিটিশ শাসনের সময় তাদের নেতৃত্বে সমাজে নতুন ধ্যানধারণার জন্ম হয়।
রাজনৈতিক অগ্রগতিতে ভূমিকা: ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন এবং স্বাধীনতার সংগ্রামে মধ্যবিত্ত শ্রেণির নেতারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৮৮৫ সালে কংগ্রেস গঠনে এ শ্রেণির ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য।
অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা: ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরি, এবং অন্যান্য পেশায় মধ্যবিত্ত শ্রেণি দেশের অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে।
ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক নেতৃত্ব: মধ্যবিত্ত শ্রেণির নেতৃত্বে নতুন ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে। তারা সমাজের ধর্মীয় সংস্কার এবং আধুনিক চিন্তাধারার সংমিশ্রণ ঘটায়।
আরো পড়ুনঃ The Grass is Singing Bangla Summary
উপসংহার: বাংলায় মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব ও বিকাশ ছিল একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়ার ফল। ব্রিটিশ শাসনের সময় শিক্ষাব্যবস্থার আধুনিকায়ন, জমিদারি ব্যবস্থার পরিবর্তন, এবং সামাজিক কাঠামোর রূপান্তরের মাধ্যমে এ শ্রেণি গড়ে ওঠে। মধ্যবিত্ত শ্রেণি শুধুমাত্র সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে নয়, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অগ্রগতিতেও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে। বর্তমান বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে এ শ্রেণির অবদান অনস্বীকার্য।