বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে গণমাধ্যমের ভূমিকা

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে গণমাধ্যমের ভূমিকা তুলে ধরো।

ভূমিকা: বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ শুধু অস্ত্রের লড়াই ছিল না; এটি ছিল বাঙালির অস্তিত্বের সংগ্রাম। এই সংগ্রামে দেশি-বিদেশি গণমাধ্যম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। গণমাধ্যম মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল বৃদ্ধি করে, বিশ্ববাসীকে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে সচেতন করে এবং আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ে সহায়তা করে। এ লেখায় মুক্তিযুদ্ধে গণমাধ্যমের অবদান তুলে ধরা হলো।  

দেশীয় পত্রপত্রিকার অগ্রণী ভূমিকা: মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকা জাতিকে সংগঠিত করতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। মুজিবনগর সরকার থেকে প্রকাশিত জয় বাংলা পত্রিকা পাকিস্তানিদের নৃশংসতা তুলে ধরে। বঙ্গবাণী, স্বদেশ ও রণাঙ্গন পত্রিকা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রেরণা জোগায়। এসব পত্রিকায় পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যা, নারী নির্যাতন ও বৈষম্যের চিত্র উঠে আসে। 

আরো পড়ুনঃ ১৯৬২ সালের পাকিস্থান সংবিধানের বৈশিষ্টসমূহ

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অবদান: স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র মুক্তিযুদ্ধের সময় তথ্যের গুরুত্বপূর্ণ উৎস ছিল। এম আর আখতার মুকুলের ‘চরমপত্র’ মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করত। গান, কবিতা ও রম্য রচনা যুদ্ধরত মানুষের মনে সাহস জোগাত। এই বেতার কেন্দ্র থেকে মুক্তিযুদ্ধের পরিস্থিতি, পাকিস্তানি সেনাদের দমনপীড়ন এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সাফল্যের খবর প্রচারিত হতো। 

বিদেশি সাংবাদিকদের সাহসিকতা: বিদেশি সাংবাদিকরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পাকিস্তানি বর্বরতা বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরেন। সাইমন ড্রিংয়ের প্রতিবেদন ডেইলি টেলিগ্রাফ-এ প্রকাশিত হয়, যেখানে তিনি ঢাকায় ২৫ মার্চের গণহত্যার বর্ণনা দেন। বিবিসি’র সাংবাদিক মার্ক টালির রিপোর্ট বিশ্ব জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। অ্যান্থনি মাসকারেনহাসের প্রবন্ধ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নৃশংসতার প্রকৃত চিত্র তুলে ধরে।  

কলকাতার পত্রিকাগুলোর ভূমিকা: ভারতের পশ্চিমবঙ্গের পত্রপত্রিকা যেমন আনন্দবাজার, যুগান্তর, দেশ, এবং অমৃতবাজার পত্রিকা মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে নানা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এ পত্রিকাগুলো পশ্চিমবঙ্গের মানুষের মনোভাব বাংলাদেশের পক্ষে নিয়ে আসে। আকাশবাণী কলকাতা মুক্তিযুদ্ধের খবর প্রচারে সক্রিয় ভূমিকা রাখে এবং শরণার্থীদের দুর্দশার চিত্র তুলে ধরে।  

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের সমর্থন: আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম মুক্তিযুদ্ধের খবর ছড়িয়ে দেয়। বিবিসি, টাইম ম্যাগাজিন, এবং নিউজউইক তাদের প্রতিবেদনে মুক্তিযুদ্ধের ন্যায্যতা তুলে ধরে। মার্কিন সাংবাদিকরা পাকিস্তানি সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। এসব প্রতিবেদন বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতি ও সমর্থন বাড়ায়।  

গণহত্যার চিত্র প্রকাশ: ২৫ মার্চ ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর সময় পাকিস্তানি বাহিনীর নির্মমতা ক্যামেরায় ধারণ করে বিদেশি সাংবাদিকরা বিশ্ববাসীর কাছে পৌঁছে দেন। এসব ছবি ও প্রতিবেদন আন্তর্জাতিক মহলে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ক্ষোভের জন্ম দেয়।  

বিশ্বজনমত গঠনে ভূমিকা: মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে পত্রিকা ও রেডিওর মাধ্যমে বিশ্বের গণমাধ্যম বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গঠন করে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, সোভিয়েত ইউনিয়নসহ বিভিন্ন দেশের গণমাধ্যম বাংলাদেশের স্বাধীনতার দাবিকে সমর্থন করে।  

আরো পড়ুনঃ ১৯৭০ সালের নির্বাচনের ফলাফল ও গুরুত্ব

শরণার্থী সংকট ও গণমাধ্যম: ভারতে আশ্রিত এক কোটি শরণার্থীর দুর্দশার খবর প্রচার করে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম। এসব প্রতিবেদন বিশ্ববাসীকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি সহানুভূতিশীল করে তোলে।  

মুক্তিযুদ্ধের যৌক্তিকতা তুলে ধরা: গণমাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য তুলে ধরে বাঙালির স্বাধীনতার দাবিকে ন্যায্য হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। এতে আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সমর্থন বৃদ্ধি পায়।  

দেশীয় সাংবাদিকদের আত্মত্যাগ: পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে অনেক সাংবাদিক শহিদ হন। দি পিপল পত্রিকার ছয়জন সাংবাদিককে হত্যা করা হয়। তবুও সাংবাদিকরা তাদের দায়িত্ব পালন থেকে বিরত হননি।  

গণসংযোগের মাধ্যম হিসেবে রেডিও: গ্রামের মানুষ রেডিওর মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের খবর জানতে পারত। আকাশবাণী কলকাতা ও বিবিসি প্রচারিত খবর গ্রামে-গঞ্জে বাঙালিদের সাহস ও প্রেরণা জোগায়।  

মুজিবনগর সরকারের প্রচারণা: মুজিবনগর সরকার আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমকে ব্যবহার করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার যৌক্তিকতা তুলে ধরে। এতে বিশ্ব জনমত গঠনে ইতিবাচক প্রভাব পড়ে।  

সংবাদপত্রের প্রতিবাদী ভূমিকা: দৈনিক আজাদ, দৈনিক সংবাদ এবং ইত্তেফাক মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জোরালো ভূমিকা পালন করে। পাকিস্তানি সেনারা এই পত্রিকাগুলোর অফিসে হামলা চালালেও তারা তাদের দায়িত্ব থেকে সরে আসেনি।  

পাকিস্তানি সেনাদের অপপ্রচারের জবাব: পাকিস্তানি সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত অপপ্রচারের জবাবে দেশি ও বিদেশি সংবাদমাধ্যম সঠিক তথ্য প্রচারে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। এতে পাকিস্তানি অপপ্রচার ব্যর্থ হয়।  

মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রসার: গণমাধ্যম মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নতুন প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেয়। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তৈরি প্রতিবেদনের মাধ্যমে জনগণ স্বাধীনতার মূল্য উপলব্ধি করে।

আরো পড়ুনঃ মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর অবদান

উপসংহার: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে গণমাধ্যম এক অসামান্য ভূমিকা পালন করে। দেশি-বিদেশি সাংবাদিক ও সংবাদমাধ্যমের প্রচেষ্টা শুধু মুক্তিযোদ্ধাদের প্রেরণা দেয়নি, বিশ্বজনমত গঠন করতেও সহায়তা করেছে। আজকের প্রজন্মের উচিত এই ইতিহাস জানা এবং গণমাধ্যমের ভূমিকা থেকে শিক্ষা নিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়া।  

Riya Akter
Riya Akter

আমি রিয়া আক্তার। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে অনার্স মাস্টার্স কমপ্লিট করেছি। ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে অনেকদিন যাবত কাজ করি। অবসর সময়ে মুভি দেখতে অনেক ভালো লাগে। ঘুরতে খুব বেশি পছন্দ করি। যে কাজের দ্বারা মানুষের ক্ষতি হবে এমন কাজ থেকে দূরে থাকি। সব সময় সৎ থাকার চেষ্টা করি।

Articles: 31