প্রাকৃতিক দুর্যোগ কী? বাংলাদেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণসমূহ

প্রাকৃতিক দুর্যোগ কী? বাংলাদেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণসমূহ / বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে দুর্যোগ বৃদ্ধির আলোচনা কর।

ভূমিকাঃ প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই কম বেশি প্রাকৃতিক দুর্যোগ সংঘটিত হয়ে থাকে। যথা: বন্যা, খরা, জলোচ্ছ্বাস, ভূমিকম্প, হারিকেন, টাইফুন, সুনামী, সিডর, আগ্নেয়গিরির উদগীরণ প্রভৃতি। এসব প্রাকৃতিক ঘটনার ফলে মানুষ মারা যায়। পশু-পাখি জীবজন্তু মারা যায়, গাছ পালা ভেঙ্গে যায়, অবকাঠামো ভেঙ্গে পড়ে প্রভৃতি ক্ষতি সাধন হয়। এসব ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমাতে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করা হয়ে থাকে।

দুর্যোগের অর্থঃ Disester ইংরেজি শব্দের প্রতিশব্দ হলো দুর্যোগ আর disaster ইংরেজি শব্দটি এসেছে ফরাসি শব্দ Desaster থেকে। অনেকে ইসলামী শব্দ Diastno থেকে এসেছে। আবার কেউ মনে করে গ্রীক শব্দ Diasmo শব্দ থেকে এসছে গ্রিক Dis অর্থ মন্দ বা খরাপ এবং ৯৬ অর্থ তারা গ্রিক রেভাতির্বিদরা মনে করতেন কোনো তারা খারাপ অবস্থায় থাকলে খারাপ ঘটনা ঘটবে। উৎপত্তিগত অর্থে দুর্যোগ বলতে বুঝায়, যা মানুষকে মন্দ বা অকল্যাণকর পরিস্থিতির সম্মুখীন করে।

আরো পড়ুনঃ অখণ্ড স্বাধীন বাংলা গঠনের পরিকল্পনা

দুর্যোগের সংজ্ঞা: পৃথিবীতে এমন কোনো দেশ নেই যেখানে প্রকৃতিক দুর্যোগ নেই। সাধারণত মানব জীবনে ভারসাম্যহীনতা এবং পরিবেশের ব্যাপক ধ্বংস সাধনের সমন্বয়ই হলো দুর্যোগ।

প্রামাণ্য সংজ্ঞা: দুর্যোগ সম্বন্ধে বিভিন্ন তাত্ত্বিক তাদের মতামত ব্যক্ত করেছেন নিম্নে তা বর্ণিত হলো:

(i) Quarajnhtelli and Dynes এর মতে, “The more appropriate definition assumes that disaster is primarily a social phenomenon and is this identity in social terms.

(ii) Burton বলেন, “Sudden and violent change in the physical. Environment threatening 60 life and property.”

(iii) স্যামুয়েল বলেছেন, “এসব কোনো চরম ঘটনা বা পরিস্থিতি যা মানুষ ও তার পরিপার্শ্বিকতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং স্বাভাবিক জীবনধারাকে বিপর্যস্ত করে এমন পর্যায়ে নিয়ে যায় যা ঐ আক্রান্ত সমাজের পক্ষে মোকাবিলা করা কষ্টসাধ্য বা ক্ষেত্র বিশেষে অসম্ভব হয়ে পড়ে।

বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণ

বাংলাদেশ একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ দেশ। দেশের ভৌগোলিক অবস্থান, জলবায়ু বৈশিষ্ট্য, এবং প্রাকৃতিক সম্পদের সীমাবদ্ধতা প্রাকৃতিক দুর্যোগ বৃদ্ধির জন্য দায়ী। নিচে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রধান কারণসমূহ উল্লেখ করা হলোঃ

১. ভৌগোলিক অবস্থানঃ বাংলাদেশ পৃথিবীর বৃহত্তম ব-দ্বীপ অঞ্চলে অবস্থিত। এটি গঙ্গা, পদ্মা, মেঘনা এবং ব্রহ্মপুত্র নদীর মোহনায় অবস্থিত হওয়ায় প্রতিবছর বন্যা এবং জলোচ্ছ্বাসের মতো দুর্যোগের শিকার হয়।

২. জলবায়ু পরিবর্তনঃ বিশ্বব্যাপী জলবায়ুর পরিবর্তন বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। তাপমাত্রা বৃদ্ধি, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং মৌসুমি বৃষ্টিপাতের পরিবর্তন দুর্যোগের প্রকোপ বাড়িয়েছে।

৩. নদীর নাব্যতা হ্রাসঃ নদীতে পলি জমার কারণে নাব্যতা হ্রাস পাচ্ছে। এতে বন্যা পরিস্থিতি প্রকট হয়ে ওঠে এবং নদীর তীরবর্তী এলাকায় ভূমিধসের ঘটনা ঘটে।

৪. ঘনবসতি ও অপরিকল্পিত নগরায়নঃ বাংলাদেশের জনসংখ্যার ঘনত্ব অত্যন্ত বেশি। অপরিকল্পিত নগরায়ন এবং ভূমি ব্যবহার প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রভাবকে আরও তীব্র করে।

৫. বনভূমি ধ্বংসঃ সুন্দরবনসহ অন্যান্য বনাঞ্চল ধ্বংসের ফলে ঘূর্ণিঝড় এবং ভূমিধসের ঝুঁকি বেড়ে গেছে। বিশেষত সুন্দরবনের গাছপালা ঘূর্ণিঝড়ের গতি কমাতে সাহায্য করে, যা বন ধ্বংসের কারণে আর সম্ভব হচ্ছে না।

৬. সাইক্লোন প্রবণতাঃ বাংলাদেশ বঙ্গোপসাগরের উপকূলে অবস্থিত, যা সাইক্লোন বেল্ট হিসেবে পরিচিত। প্রতি বছর ঘূর্ণিঝড় এবং জলোচ্ছ্বাসের মতো দুর্যোগের সম্মুখীন হতে হয়।

আরো পড়ুনঃ যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে বঙ্গবন্ধুর পদক্ষেপসমূহ

সাম্প্রতিক সময়ে দুর্যোগ বৃদ্ধির কারণ

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রকোপ উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এর পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে:

১. জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবঃ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ঘূর্ণিঝড়, বন্যা এবং খরার মতো দুর্যোগের তীব্রতা এবং ঘনত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে। সাম্প্রতিক ঘূর্ণিঝড় “সিত্রাং” জলবায়ু পরিবর্তনের সরাসরি প্রভাব।

২. সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিঃ গ্লোবাল ওয়ার্মিং-এর কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়েছে, যা উপকূলীয় অঞ্চলে জলোচ্ছ্বাস এবং লবণাক্ততার সংকট সৃষ্টি করেছে। এতে কৃষি জমি এবং মিঠাপানির উৎস ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

৩. বনভূমি হ্রাসঃ সুন্দরবনের মতো বনাঞ্চল উজাড় হওয়ার ফলে ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাব আরও ভয়াবহ হয়ে উঠছে। বনভূমি ঝড়ের গতি কমাতে কার্যকর ভূমিকা পালন করত।

৪. নদীর সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবঃ বাংলাদেশে নদীগুলোর সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে প্রতি বছর বন্যা এবং নদীভাঙনের ঘটনা বাড়ছে। বর্ষার সময় পানি জমে ব্যাপক ক্ষতি করে।

৫. অপরিকল্পিত নগরায়নঃ ঢাকা, চট্টগ্রামসহ প্রধান শহরগুলোতে অপরিকল্পিত নগরায়ন এবং সঠিক ড্রেনেজ ব্যবস্থা না থাকার কারণে সামান্য বৃষ্টিতেও জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়।

৬. পরিবেশ দূষণঃ অতিরিক্ত কার্বন নিঃসরণ, রাসায়নিক পদার্থের ব্যবহার এবং শিল্পবর্জ্য পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করছে। এর ফলে প্রাকৃতিক দুর্যোগের তীব্রতা বেড়েছে।

বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রভাব

প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাংলাদেশে বহুমাত্রিক প্রভাব ফেলে।

১. জীবনহানি ও সম্পদের ক্ষতি: বন্যা, ঘূর্ণিঝড়ের মতো দুর্যোগে প্রতিবছর হাজার হাজার মানুষ মারা যায় এবং বিপুল সম্পদের ক্ষতি হয়।

২. কৃষি উৎপাদনে ধস: দুর্যোগের ফলে কৃষি জমি নষ্ট হয়, ফসল নষ্ট হয় এবং খাদ্য সংকট দেখা দেয়।

৩. পরিবেশগত প্রভাব: বন্যা এবং ঘূর্ণিঝড় পরিবেশের উপর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলে।

৪. অর্থনৈতিক ক্ষতি: দুর্যোগ মোকাবিলায় প্রচুর অর্থ ব্যয় হয়, যা দেশের অর্থনীতির উপর চাপ সৃষ্টি করে।

উত্তরণের উপায়ঃ বাংলাদেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রকোপ কমানোর জন্য কিছু কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে:

১. পরিবেশ সংরক্ষণঃ বনভূমি সংরক্ষণ এবং পুনরায় বনায়নের মাধ্যমে পরিবেশ রক্ষায় উদ্যোগ নিতে হবে।

আরো পড়ুনঃ বাংলাদেশের জনগণের নৃ-তাত্ত্বিক পরিচয়

২. জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলাঃ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কমাতে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার এবং কার্বন নিঃসরণ কমানোর দিকে মনোযোগ দিতে হবে।

৩. নদী ব্যবস্থাপনাঃ নদীর নাব্যতা বৃদ্ধি এবং পানির সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।

৪. পরিকল্পিত নগরায়নঃ শহরাঞ্চলে পরিকল্পিত অবকাঠামো গড়ে তুলতে হবে, যাতে বন্যা এবং জলাবদ্ধতা রোধ করা যায়।

৫. জনসচেতনতা বৃদ্ধিঃ দুর্যোগ মোকাবিলায় জনগণকে সচেতন করতে এবং দুর্যোগ প্রস্তুতির প্রশিক্ষণ দিতে হবে।

উপসংহারঃ বাংলাদেশ একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ দেশ। ভৌগোলিক অবস্থান, জলবায়ু পরিবর্তন এবং পরিবেশগত অসামঞ্জস্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঘটনা বৃদ্ধি করছে। এ থেকে উত্তরণের জন্য পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা, এবং সচেতনতা বৃদ্ধি অত্যন্ত জরুরি। একই সঙ্গে টেকসই উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করে দুর্যোগের ক্ষতি কমিয়ে আনা সম্ভব।

Sima Khatun
Sima Khatun

আমি সিমা খাতুন। আমি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি বিষয়ে অনার্স ও মাস্টার্স
কমপ্লিট করেছি। ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে আমার অনেক অভিজ্ঞতা রয়েছে। আমি শিক্ষার্থীদের ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য সহজভাবে শেখাতে কাজ করি। শিক্ষার্থীদের সাহিত্যের প্রতি আগ্রহ বাড়ানোই আমার লক্ষ্য।

Articles: 128