বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির গতিপ্রকৃতি বর্ণনা করো।
ভূমিকা: রাজনৈতিক সংস্কৃতি হলো রাজনৈতিক বিষয়াবলীর প্রতি নাগরিকদের দৃষ্টিভঙ্গির এক সামগ্রিক বন্ধন ব্যবস্থা। জনগণের রাজনৈতিক মনোভাব, রাজনৈতিক অংশগ্রহণ, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম এবং ক্ষমতার ভারসাম্যের ওপর ভিত্তি করে রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে উঠে। বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক চর্চার পাশাপাশি এখানে দলীয় স্বার্থ, সংঘাত, নেতাকেন্দ্রিক রাজনীতি, এবং সামাজিক বিভাজন রয়েছে। রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রকৃতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, রাজনৈতিক সংস্কৃতির গুণগত মানের ওপরসে দেশের গণতান্ত্রিক বিকাশ ও সুশাসন অনেকাংশে নির্ভরশীল।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য ও প্রকৃতি: রাজনৈতিক সংস্কৃতি হল কোন দেশের জনগণের রাজনৈতিক মূল্যবোধ, দৃষ্টিভঙ্গি, আচরণ ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের প্রতি মনোভাব। এটি একটি জাতির রাজনৈতিক সচেতনতা, অংশগ্রহণ, বিশ্বাস, ও শাসনব্যবস্থার প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন। নিচে রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য আলোচনা করা হলো;
১। অভিজ্ঞতাভিত্তিক বিশ্বাস: বাংলাদেশের জনগণ রাজনৈতিক দল ও নেতাদের অতীত কর্মকাণ্ডের ভিত্তিতে তাদের ওপর আস্থা বা অনাস্থা প্রকাশ করে। তবে, অনেক সময় এই বিশ্বাস যুক্তিনির্ভর না হয়ে আবেগনির্ভর হয়ে থাকে যেটি গঠনমূলক রাজনৈতিক সংস্কৃতির পথে অন্তরায় সৃষ্টি করে।
আরো পড়ুন: গ্রাম থেকে শহরের স্থানান্তরের কারণ ও ফলাফল
২। সংবেদনশীল মনোভাব: বাংলাদেশের জনগণ রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত সংবেদনশীল। এদেশের মানুষের মাঝে বিরোধী মতামত গ্রহণ করার সংস্কৃতি খুবই কম। এখানে প্রায়ই রাজনৈতিক মতভেদ থেকে ব্যক্তিগত আক্রমণ ও সামাজিক বিভক্তি তৈরি হয়।
৩। নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়: আদর্শ ও নৈতিকতার অবক্ষয় রাজনৈতিক সংস্কৃতির অন্যতম সমস্যা। ক্ষমতা হস্তগত করার জন্য অনেক সময় রাজনৈতিক নেতারা নীতি-নৈতিকতার তোয়াক্কা করে না বরং ক্ষমতার জন্য তারা যেকোন অপকর্ম করতে দ্বিধাবোধ করে না।
৪। একচোখা নীতি ও পক্ষপাতিত্ব: বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে দলীয় আনুগত্য অত্যন্ত প্রবল। জনগণ যে দল বা মতবাদকে সমর্থন করে, তারা সেই দলের নেতাদের ভুলকেও সমর্থন করে এবং বিরোধী দলের ভালো কাজকেও অবমূল্যায়ন করে।
৫। দলীয়করণ ও প্রভাব বিস্তার: প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও গণমাধ্যমেও রাজনৈতিক দলগুলোর প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। অযাচিত হস্তক্ষেপের ফলে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হয় এবং সুশাসন ব্যাহত হয়।
৬। সংঘাত ও সহিংসতার প্রবণতা: বাংলাদেশে দেখা যায়, রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা গঠনমূলক সমালোচনা মাধ্যমে সমাধান না হয়ে অনেক সময় সংঘর্ষে রূপ নেয়। নির্বাচনকালীন সহিংসতা, ছাত্র রাজনীতির নামে দাঙ্গা, ও রাজনৈতিক প্রতিহিংসা এদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির ক্ষেত্রে একটি বড় বাধা।
৭। ব্যক্তিকেন্দ্রিক রাজনীতি: অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, বাংলাদেশের জনগণ রাজনৈতিক আদর্শ বা নীতির চেয়ে ব্যক্তির জনপ্রিয়তাকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকে। ফলশ্রুতিতে রাজনৈতিক দলগুলো গণতন্ত্র চর্চার পরিবর্তে একনায়কতন্ত্রের পথে পরিচালিত হয়।
৮। জনমতের সীমিত গুরুত্ব: শক্তিশালী জনমত থাকা সত্ত্বেও সরকার বা রাজনৈতিক দলগুলো অনেক সময় জনগণের চাহিদাকে উপেক্ষা করে। এতে গণতান্ত্রিক চর্চা বাধাগ্রস্ত হয় এবং রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা কমে যায়।
৯। নেতৃত্ব সংকট: বাংলাদেশের রাজনীতিতে সৎ, নীতিবান ও দূরদর্শী নেতৃত্বের অভাব প্রকট। যোগ্য নেতৃত্ব গড়ে তোলার ব্যবস্থা না থাকায়, অনেক ক্ষেত্রে পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতির প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়।
আরো পড়ুন: বাংলাদেশের সমাজ ও সংস্কৃতির উপর বিশ্বায়নের প্রভাব
১০। গণমাধ্যমের প্রভাব: নিরপেক্ষ সংবাদমাধ্যম কোন দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তবে বাংলাদেশে অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় গণমাধ্যম নিরপেক্ষ না থেকে দলীয় প্রচারমাধ্যমে পরিণত হয় যার ফলে জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি করে।
১১। রাজনৈতিক প্রতিহিংসা: বাংলাদেশের মতো দেশে ক্ষমতার পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে প্রতিপক্ষের ওপর দমন-পীড়ন শুরু হয়। মিথ্যা মামলা, প্রশাসনিক হয়রানি, এবং বিরোধী মত দমন করা রাজনৈতিক সংস্কৃতির অন্যতম দিক।
১২। নির্বাচনী ব্যবস্থার দুর্বলতা: বাংলাদেশে নির্বাচন গণতন্ত্রের অন্যতম ভিত্তি হলেও, নির্বাচন পরিচালনায় অনেক সময় অনিয়ম ও কারচুপির অভিযোগ ওঠে। সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত না হলে রাজনৈতিক সংস্কৃতির উন্নয়ন অসম্ভব।
১৩। সুশাসনের অভাব: সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সংস্কৃতির ভূমিকা অপরিসীম। রাজনৈতিক সংস্কৃতি দুর্বল হলে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার বদলে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ে।
১৪। রাজনৈতিক সামাজিকীকরণ: পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান এবং গণমাধ্যম রাজনৈতিক বিশ্বাস ও মূল্যবোধ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তবে, রাজনৈতিক শিক্ষার অভাবে অনেক সময় মানুষ দলীয় প্রচারের শিকার হয়।
১৫। অংশগ্রহণমূলক রাজনীতির অভাব: রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণের সুযোগ থাকা উচিত। কিন্তু বাস্তবে খুব একটা দেখা যায়। রাজনৈতিক দলগুলো মূলত ক্ষমতা দখল ও রক্ষা নিয়ে ব্যস্ত থাকার ফলে জনগণের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ কমে যায়।
১৬। ভিন্নমতের প্রতি অসহিষ্ণুতা: গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি মতপ্রকাশের স্বাধীনতা। কিন্তু বাংলাদেশে ভিন্নমত পোষণ করলেই তাকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হিসেবে দেখা হয় এবং সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন করার প্রবণতা দেখা যায়।
১৭। জাতীয় ঐক্যের অভাব: রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতভেদ থাকলেও জাতীয় স্বার্থে ঐক্য থাকা উচিত। কিন্তু বাস্তবে বাংলাদেশে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলোতে দলগুলো ঐকমত্যে পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়, যা দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য ক্ষতিকর এবং হুমকিস্বরূপ।
আরো পড়ুন: ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায়, একটি দেশের গণতান্ত্রিক বিকাশ ও সুশাসন সে দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির ওপর নির্ভরশীল। তবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি নানা ইতিবাচক ও নেতিবাচক বৈশিষ্ট্যের সংমিশ্রণে মিশ্রিত। এ দেশের জনগণ গণতন্ত্রের প্রতি আগ্রহী কিন্তু দলীয়করণ, সংঘাত, একনায়কতন্ত্রের প্রবণতা ও দুর্নীতি বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে প্রতিনিয়ত দুর্বল করছে। এ সংস্কৃতি উত্তরণে রাজনৈতিক সচেতনতা, শক্তিশালী গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান, সুশাসন, এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এদেশের সকল জনগণ যদি দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে যোগ্য নেতৃত্বকে বেছে নেয় তবে বাংলাদেশে একটি ন্যায়সঙ্গত ও গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তোলা সম্ভব।