বাংলাদেশের জাতীয় উন্নয়নের রেমিটেন্স এর গুরুত্ব

বাংলাদেশের জাতীয় উন্নয়নের রেমিটেন্স এর গুরুত্ব আলোচনা কর।

নিরাপদ আশ্রয়, উন্নত জীবনের প্রত্যাশায়, নব আবিষ্কারের নেশায় কিংবা কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তায় প্রভৃতি কারণে সভ্যতার উষালগ্ন থেকে মানুষ একস্থান থেকে অন্যস্থানে ছুটে বেড়াচ্ছে এ স্থানান্তরের একটি বড় কারণ হলো অর্থনৈতিক কারণ। বস্তুত সকল উন্নয়নশীল (বাংলাদেশসহ) দেশের মানুষ উন্নত দেশ হতে প্রচুর পরিমাণ বৈদেশিক অর্থ (রেমিট্যান্স) নিজ নিজ দেশে প্রেরণ করে। আর এ রেমিট্যান্স এসব দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

রেমিট্যান্স বা বৈদেশিক মুদ্রা (Remittance) : Remittance ইংরেজি শব্দ। এর বাংলা প্রতিশব্দ হলো প্রবাসীদের প্রেরিত অর্থ বা বৈদেশিক মুদ্রা। সুতরাং শব্দগত অর্থে বলা যায় যে, কোনো প্রবাসী বা বিদেশে অবস্থিত ব্যক্তিবর্গ তাদের অর্জিত অর্থ নিজেদের প্রয়োজন মিটিয়ে উদ্বৃত্তের যে অংশ দেশে প্রেরণ করে তাই হলো রেমিট্যান্স। অন্যভাবে বলা যায়, ভবিষ্যৎ সুখসমৃদ্ধি লাভের আশায় কোন প্রবাসী ব্যক্তিবর্গ তাদের কষ্টার্জিত অর্থের যে উদ্বৃত্ত অংশ নিজ নিজ দেশে বে করে তাকে রেমিট্যান্স বা বৈদেশিক মুদ্রা বলা হয়।

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে রেমিট্যান্সের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা : উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে রেমিট্যান্স গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে রেমিট্যান্সের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হলো :

আরো পড়ুন: গ্রাম থেকে শহরের স্থানান্তরের কারণ ও ফলাফল

১. জাতীয় আয় বৃদ্ধি : বাংলাদেশের জাতীয় আয়ের বৃহৎ একটি অংশ বা খাত হলো রেমিট্যান্স। মূলত বাংলাদেশের জাতীয় বৃদ্ধি এদেশের জাতীয় উন্নয়নকে গতিশীল করেছে। আর এ কারণে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ২০০২ সালে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় নামে একটি স্বতন্ত্র মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করে।

২. কর্মসংস্থান সৃষ্টি : বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ বেকার। অথচ এ বেকার জনসংখ্যার অধিকাংশই আবার শিক্ষিত ও কর্মক্ষম। এমতাবস্থায় ধার দেনা করে প্রতি বছর বহু বেকার মানুষ বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে কর্মসংস্থানের আশায় পাশাপাশি বিদেশে অবস্থিত প্রবাসীরা দেশে প্রচুর রেমিট্যান্স পাঠিয়ে দেশে নতুন নতুন শিল্পকারখানা গড়ে তুলছে। ফলে সৃষ্টি হচ্ছে নতুন নতুন কর্মসংস্থানের।

৩. মূলধন গঠন : মূলধন যে কোনো দেশের অর্থনীতিতে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। সাধারণত এর উপরেই দেশের শিল্পকারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসারিত হয়। আর যদি দেশটি উন্নয়নশীল কিংবা অনুন্নত হয় তাহলে সে দেশের এ মূলধন গঠনে রেমিট্যান্স যথেষ্ট সাহায্য করে।

৪. জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন : উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার উন্নয়নে বৈদেশিক মুদ্রার বা রেমিট্যান্সের গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না। কারণ রেমিট্যান্সের মাধ্যমে এ দেশের মাথাপিছু আয় (G.D.P) ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

৫. গ্রামীণ অর্থনীতি শক্তিশালী করণ : বাংলাদেশ গ্রাম প্রধান দেশ। গ্রামীণ অর্থনীতি এ দেশের জাতীয় অর্থনীতির সিংহভাগ দখল করে আছে। আর এ গ্রামীণ অর্থনীতিকে শক্তিশালী করণের ক্ষেত্রে সম্প্রতি কৃষির পাশাপাশি আরেকটি খাত উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করছে। সে খাতটি হলো রেমিট্যান্স ।

৬. শিল্পোন্নয়ন: অর্থনৈতিক দিক দিয়ে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে। অথচ অধিকহারে নগরায়ণ ও শিল্পায়নের জন্য প্রচুর অর্থের প্রয়োজন । এমতাবস্থায় রেমিট্যান্স বৃদ্ধির মাধ্যমে মূলধন গঠন করে এদেশে একক কিংবা যৌথ উদ্যোগে নতুন নতুন শিল্পকারখানা গড়ে উঠছে। আর এভাবে আমাদের এ দেশটি শিল্পক্ষেত্রে যত উন্নত হবে এ দেশের জাতীয় অর্থনীতি তত গতিশীল হবে।

আরো পড়ুন: ধর্ম নিরপেক্ষ শিক্ষা কি?

৭. ভোগের হার বৃদ্ধি : বাংলাদেশের রেমিট্যান্সের বৃদ্ধির মাধ্যমে আপামর জনসাধারণের আয়ের হার বৃদ্ধি করা যায়। বস্তুত এ দেশের যেসব পরিবারের সদস্য প্রবাসী বিদেশে কর্মরত সেসব পরিবারের আর্থিক অবস্থা যথেষ্ট ভালো থাকে। এর ভালো আর্থিক অবস্থা মানুষকে ভোগের হার বা মাত্রা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।

৮. জাতীয় উৎপাদন বৃদ্ধি : এদেশের জাতীয় মূলধন বৃদ্ধিতে রেমিট্যান্স বা বৈদেশিক মুদ্রা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আর এ মূলধন মানুষ কৃষি, শিল্পকারখানায় ব্যবসা-বাণিজ্য প্রভৃতি ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করে উৎপাদন বৃদ্ধি করতে পারে । এর উৎপাদন বৃদ্ধির প্রবণতা জাতীয় উন্নয়নের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

৯. বিনিয়োগের বৃদ্ধি : দেশের রিনিয়োগের বৃদ্ধির ক্ষেত্রে রেমিট্যান্স গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। রেমিট্যান্সের মাধ্যমে প্রাপ্ত অর্থ মূলধন গঠনে সহায়ক হয়। আর এ মূলধন গঠিত হলে তা পুনরায় বিনিয়োগের মাধ্যমে অতিরিক্ত মুনাফা অর্জনের সুযোগ সৃষ্টি হয় ।

১০. অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন : বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থাকে ত্বরান্বিত করতে হলে এদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অত্যাবশ্যক। আর এদেশে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে রেমিট্যান্স গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বস্তুত এ দেশের প্রবাসীদের পাঠানো অর্থের মাধ্যমে আয়, সঞ্চয়, ভোগ, বিনিয়োগ ও মূলধন গঠনের প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

১১. বৈদেশিক সাহায্যের নির্ভরশীলতা হ্রাস ; কেবল বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের সকল উন্নয়নশীল দেশ বৈদেশিক সাহায্যের উপর অধিকহারে নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। এতে করে নানান ধরনের সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। এমতাবস্থায় এ বৈদেশিক সাহায্যের হাত থেকে মুক্তি পেতে হলে দেশে প্রচলিত রেমিট্যান্স হার বৃদ্ধি করতে হবে।

১২. রাজনীতিতে রেমিট্যান্সের গুরুত্ব: রেমিট্যান্স অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখে, যা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এটি সরকারের উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে সহায়তা করে এবং বাজেট ঘাটতি কমায়। বিদেশ নীতিতে রেমিট্যান্স কূটনৈতিক সম্পর্ক উন্নত করতে ভূমিকা রাখে। প্রবাসীদের স্বার্থ রক্ষায় সরকার নীতি গ্রহণ করে, যা রাজনৈতিক জনপ্রিয়তা বাড়ায়। এছাড়া, প্রবাসীরা রাজনৈতিক দলগুলোর অর্থায়নে সহায়তা করে এবং নির্বাচনে প্রভাব রাখে। ফলে রেমিট্যান্স দেশের রাজনীতি ও অর্থনীতিতে গভীরভাবে যুক্ত।

১৩. মুদ্রার স্থিতিশীলতা রক্ষা: রেমিট্যান্স দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ায়, যা টাকার মান স্থিতিশীল রাখতে সাহায্য করে। বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ বেশি থাকলে আমদানি ব্যয় মেটানো সহজ হয় এবং দেশের অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা বজায় থাকে।

১৪. সামাজিক উন্নয়নে অবদান: প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ দেশের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আবাসন, পানীয় জল সরবরাহ, বিদ্যুৎ সুবিধার মতো সামাজিক উন্নয়নের খাতে ব্যয় হয়। এতে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত হয় এবং সামগ্রিক উন্নয়নের গতি বাড়ে।

১৫. সরকারি রাজস্ব বৃদ্ধি: রেমিট্যান্স থেকে সরকার কর ও শুল্ক আদায় করে, যা বাজেট ঘাটতি কমাতে সাহায্য করে। এই রাজস্ব দেশের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যয় করা হয়, যা জাতীয় উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করে।

১৬. দারিদ্র্য বিমোচন: রেমিট্যান্সের ফলে অনেক পরিবার অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয় এবং দারিদ্র্য থেকে বেরিয়ে আসে। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে বসবাসকারী মানুষদের জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়, যা সামগ্রিকভাবে দারিদ্র্য কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

আরো পড়ুন: বাংলাদেশের সমাজ ও সংস্কৃতির উপর বিশ্বায়নের প্রভাব

উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, প্রবাসীরা তাদের অর্জিত অর্থ নিজেদের প্রয়োজন মিটিয়ে উদ্বৃত্তের যে অংশ নিজ নিজ দেশে প্রেরণ করে তাকে রেমিট্যান্স বলে। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে রেমিট্যান্স গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কারণ রেমিট্যান্স বা বৈদেশিক মুদ্রার হার বৃদ্ধি পেলে তা দ্বারা বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের সহজে দারিদ্র্য দূরীকরণ, জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন, জাতীয় আয় বৃদ্ধি, শিল্পক্ষেত্রে উন্নয়ন, ভোগের পরিমাণ বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন উন্নয়ন সাধন করা যাবে।

Shihabur Rahaman
Shihabur Rahaman
Articles: 33