সামাজিক নিয়ন্ত্রণের বাহনসমূহ

সামাজিক নিয়ন্ত্রণের বাহনসমূহ আলোচনা করো।

শৃঙ্খলাবদ্ধ সমাজ এবং সুষ্ঠু জীবনযাপন নিশ্চিত করতে সামাজিক নিয়ন্ত্রণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি এমন একটি প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে সমাজে বসবাসরত ব্যক্তিবর্গ একে অপরের আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে এবং সমাজের নির্দিষ্ট নিয়ম ও রীতি অনুসরণ করতে উদ্বুদ্ধ হয়। সামাজিক নিয়ন্ত্রণের বাহনসমূহ সমাজের অভ্যন্তরে নির্দিষ্ট আচরণগত বিধি প্রবর্তন ও বাস্তবায়ন করে থাকে। এই বাহনগুলোর মাধ্যমে ব্যক্তির আচরণ নির্ধারণ এবং সমাজে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হয়। সামাজিক নিয়ন্ত্রণের বিভিন্ন বাহন রয়েছে, যেমন পরিবার, ধর্ম, আইন, শিক্ষা, জনমত, লোকাচার ইত্যাদি। নিচে সেগুলোর বিস্তারিত আলোচনা করা হলো: 

সামাজিক নিয়ন্ত্রণের বাহনসমূহ

১. পরিবারঃ  সামাজিক নিয়ন্ত্রণের প্রথম এবং সবচেয়ে প্রভাবশালী বাহন হল পরিবার। এটি সামাজিক নিয়ন্ত্রণের মূল ভিত্তি। পরিবারে মাধ্যমেই ব্যক্তির নৈতিক মূল্যবোধ এবং আচরণ গড়ে ওঠে।  সর্বপ্রথম শিশুরা পরিবার থেকেই সমাজের মূলনীতি এবং সঠিক ও ভুলের পার্থক্য শিখে। বিশৃঙ্খলাপূর্ণ পরিবার থেকে সমাজে অপরাধ এবং বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি  হতে পারে।  তাই একটি শৃঙ্খলাবদ্ধ পরিবারই সমাজে সুস্থ ব্যক্তি তৈরি করে।

আরো পড়ুনঃ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভূমিকা

২. ধর্মঃ সামাজিক নিয়ন্ত্রণের অত্যন্ত শক্তিশালী বাহন ধর্ম। ধর্মীয় বিশ্বাস ও বিধি-নিষেধ মানুষের আচরণকে প্রভাবিত করে এবং সঠিক পথ অনুসরণে সহায়তা করে। ধর্মীয় রীতি নীতি সমাজে ন্যায়, সত্য ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত করে। উদাহরণস্বরূপ, ইসলাম ধর্মে মানুষের মধ্যে সামাজিক শৃঙ্খলা এবং নৈতিকতার শিক্ষা দেওয়া হয়। ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান এবং বিধি-নিষেধ সামাজিক শৃঙ্খলা বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

৩. লোকাচার ও লোকনীতিঃ লোকাচার এবং লোকনীতি সমাজের সাংস্কৃতিক ভিত্তি। লোকাচার হলো সমাজে প্রচলিত আচরণগত রীতিগুলি যেগুলি সমাজে বসবাসকারী ব্যক্তিবর্গ মেনে চলে। যখন সমাজে কোন আচরণ বা রীতিকে গ্রহণযোগ্য হিসেবে মেনে নেওয়া হয়, তখন তা লোকনীতির মধ্যে পরিণত হয়। লোকনীতি সমাজের নৈতিকতা এবং আদর্শকে নির্দেশ করে। এটি সমাজের ভেতর ঐক্য এবং সংহতি সৃষ্টি এবং একে অপরকে সামাজিক শৃঙ্খলা মেনে চলতে উদ্বুদ্ধ করে। 

৪. আইনঃ আইন সামাজিক নিয়ন্ত্রণের একটি আনুষ্ঠানিক বাহন যেটি সমাজের শৃঙ্খলা এবং ব্যক্তির অধিকার ও কর্তব্য নির্ধারণে সাহায্য করে। আইন অপরাধের শাস্তি নির্ধারণ করে এবং অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়। আইনের মাধ্যমে সমাজে ন্যায়ের প্রতিফলন ঘটে এবং ব্যক্তি তার কর্মকাণ্ড সম্পর্কে সচেতন হয়। আইনের কঠোরতা সমাজে অপরাধের হার কমিয়ে, শৃঙ্খলা বজায় রাখতে  সহায়তা করে। 

৫. শিক্ষাঃ শিক্ষা সামাজিক নিয়ন্ত্রণের গুরুত্বপূর্ণ বাহন। এটি মানুষকে কুসংস্কার, অজ্ঞতা ও অন্ধবিশ্বাস থেকে মুক্ত করে এবং যুক্তিসংগত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা প্রদান করে। শিক্ষা সমাজের সদস্যদের মাঝে নৈতিক মূল্যবোধ গড়ে তোলে। শিক্ষা ব্যক্তি বা সমাজের অন্তর্নিহিত পরিবর্তন আনে, যা সামাজিক নিয়ন্ত্রণের অন্যতম কার্যকরী মাধ্যম হিসেবে কাজ করে।

৬. জনমতঃ জনমত একটি শক্তিশালী অনানুষ্ঠানিক নিয়ন্ত্রণ বাহন। এটি একটি সমাজের সদস্যদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ সচেতনতা তৈরি করে এবং তাদের আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে। সমাজে জনমতের শক্তি অনেক বড়, কারণ জনমতের প্রভাবে মানুষের আচরণ শোধরানো এবং সামাজিক শৃঙ্খলা বজায় রাখা সহজ হয়। জনমত মানুষের স্বাভাবিক আচরণ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।

৭. মাধ্যমিক প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনঃ স্কুল, কলেজ, কর্মস্থল, রাজনৈতিক দল এবং সামাজিক সংগঠনগুলোও সামাজিক নিয়ন্ত্রণের বাহন হিসেবে কাজ করে। এসব প্রতিষ্ঠান ব্যক্তিকে একটি নির্দিষ্ট নিয়মের আওতায় রাখে এবং তাদের আচরণ, কাজ এবং চিন্তাভাবনা নিয়ন্ত্রণ করে। উদাহরণস্বরূপ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক এবং কর্মস্থলে কর্মচারীদের আচরণ নিয়মিত নিয়মের মধ্যে থাকে, যা শৃঙ্খলা বজায় রাখতে সহায়তা করে।

৮. মাধ্যমিক নীতিমালাঃ পত্রিকা, টেলিভিশন, রেডিও, এবং অন্যান্য গণমাধ্যমগুলি মানুষের আচরণ এবং সমাজের সৃজনশীলতা নিয়ন্ত্রণ করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই মাধ্যমগুলো মানুষকে তথ্য দেয় এবং তাদের সচেতনতা বৃদ্ধি করে, যা সমাজের মধ্যে এক ধরনের নিয়ন্ত্রণ সৃষ্টি করে।

আরো পড়ুনঃ পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্যমূলক নীতিসমূহ

৯. বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিমালাঃ বিশ্ববিদ্যালয়ের কোড অব কন্ডাক্ট ছাত্রদের আচরণ নিয়ন্ত্রণ করতে সহায়তা করে। এতে শিক্ষার্থীরা শৃঙ্খলা ও নৈতিকতার আচরণ শিক্ষা লাভ করে।

১০. সামাজিক প্রতিক্রিয়াঃ  সমাজের ভিতর যখন কোন ব্যক্তি সামাজিক নিয়ম ভঙ্গ করে, তখন সমাজ তার প্রতি প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। সমাজ তাকে নিন্দা বা শাস্তি দিয়ে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করে। এটি সামাজিক নিয়ন্ত্রণের একটি শক্তিশালী বাহন। 

১১. সাংস্কৃতিক প্রথা ও ঐতিহ্যঃ সামাজিক নিয়ন্ত্রণে সাংস্কৃতিক প্রথা ও ঐতিহ্যও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রতিটি সমাজের নিজস্ব সাংস্কৃতিক রীতি-নীতি থাকে, যা সদস্যদের আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে। এসব প্রথা সমাজে সম্মান এবং শৃঙ্খলা বজায় রাখতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।

১২. মানসিক চাপঃ সমাজের প্রতিটি মানুষের একে অপরকে বিচার করার প্রবণতা থাকে। কেউ যদি সামাজিক নিয়ম ভঙ্গ করে, তবে তার ওপর মানসিক চাপ সৃষ্টি হয়, যা তাকে নিয়ম মেনে চলতে প্ররোচিত করে। 

১৩. সামাজিক পরিবেশঃ সামাজিক পরিবেশের প্রভাবও এক ধরনের সামাজিক নিয়ন্ত্রণের বাহন। যেমন, যে পরিবেশে একজন ব্যক্তি বসবাস করে, তার মধ্যে সেই পরিবেশের সামাজিক শৃঙ্খলা প্রতিফলিত হয়। সুষ্ঠু পরিবেশ একজন ব্যক্তিকে সঠিকভাবে চলতে উৎসাহিত করে।

১৪. সামাজিক উদ্যোড়ঃ সমাজে বিভিন্ন সামাজিক উদ্যোগ এবং সচেতনতা প্রচারণা জনগণের মধ্যে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ উদ্যোগগুলো সমাজে বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে সহায়তা করে এবং মানুষকে সঠিক পথনির্দেশনা প্রদান করে।

১৫. অর্থনৈতিক ব্যবস্থাঃ অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সমাজের আচরণ নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কাজের সুযোগ, আয় এবং অর্থনৈতিক অবস্থা মানুষের জীবনধারা প্রভাবিত করে এবং শৃঙ্খলা বজায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।

আরো পড়ুনঃ লাহোর প্রস্তাব কি?

পরিশেষে পাওয়া যায়, সামাজিক নিয়ন্ত্রণের বাহনসমূহ সমাজে শৃঙ্খলা, শান্তি এবং সহযোগিতা বজায় রাখতে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। এই বাহনগুলোর সমন্বিত প্রয়োগের মাধ্যমে সমাজে সঠিক আচরণ নিশ্চিত করা সম্ভব। পরিবার, ধর্ম, আইন, শিক্ষা, জনমত, এবং অন্যান্য বাহনগুলো সমাজের সদস্যদের জন্য একটি শৃঙ্খলিত জীবনধারা তৈরি করতে সহায়তা করে।

Sima Khatun
Sima Khatun

আমি সিমা খাতুন। আমি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি বিষয়ে অনার্স ও মাস্টার্স
কমপ্লিট করেছি। ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে আমার অনেক অভিজ্ঞতা রয়েছে। আমি শিক্ষার্থীদের ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য সহজভাবে শেখাতে কাজ করি। শিক্ষার্থীদের সাহিত্যের প্রতি আগ্রহ বাড়ানোই আমার লক্ষ্য।

Articles: 128