সামাজিকীকরণে পরিবার ও ধর্মের ভূমিকা

সামাজিকীকরণ বলতে কি বুঝ? সামাজিকীকরণে পরিবার ও ধর্মের ভূমিকা আলোচনা কর। [NU- 2013, 16, 20]

ভূমিকা: সামাজিকীকরণ একটি জীবনব্যাপী প্রক্রিয়া। শিশুর জন্মের পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত এ প্রক্রিয়ায় জীবন চলতে থাকে। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ব্যক্তি যখন এক পর্যায় থেকে আরেক পর্যায়ে প্রবেশ করে তখন তাকে নতুন পরিবেশের সঙ্গে, নতুন অবস্থার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে হয়। এ খাপ খাওয়ানো প্রক্রিয়ার ফলে তার আচরণে পরিবর্তন আসে। নতুন নিয়মকানুন, রীতিনীতি এবং নতুন পরিবেশ-পরিস্থিতির সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে চলার প্রক্রিয়ার নাম সামাজিকীকরণ। 

সামাজিকীকরণের পরিবার ও ধর্মের ভূমিকা: বহু দল ও প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ব্যক্তির সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয় তন্মধ্যে পরিবার ও ধর্ম অন্যতম। পরিবারেই মানুষের সামাজিকতার সূচনা হয় আর ধর্ম মানুষকে নীতি-আদর্শ  শিক্ষা দেয় ।

 নিম্নে সামাজিকীকরণে পরিবারের ভূমিকা আলোচনা করা হলো;

নবজাতকের ওপর প্রভাব: পরিবার হলো শিশুর প্রথম আশ্রয়স্থল। জন্মের পর  পরিবারই প্রথম নবজাতককে গ্রহণ করে। এ সময় শিশুর কোমল মনের প্রতি পারিবারিক ধ্যান-ধারণার প্রতিফলন ঘটে যা শিশুর ভবিষ্যৎ জীবনে প্রভাব বিস্তার করে। কেননা,এটা স্বীকৃত যে, ব্যক্তির মনের ওপর তার পারিবারিক অভিজ্ঞতা স্থায়ীভাবে প্রভাব বিস্তার করে। 

আরো পড়ুন: সমাজকর্মের মৌলিক পদ্ধতি তিনটি পরস্পর সম্পর্কযুক্ত

শিক্ষা-দীক্ষায় পরিবারের ভূমিকা: বলা হয়ে থাকে, পরিবার শিশুর প্রথম শিক্ষালয় এবং মা তার প্রধান শিক্ষক। মূলত পরিবারে একটি শিশুকে জোর পূর্বক কোন কিছু শিক্ষা দেওয়া হয় না। যার কারণে শিশু পরিবার থেকে সহজে শিক্ষা গ্রহণ করে যা তার পরবর্তী জীবনে প্রতিফলিত হয়। 

সামাজিক নিরাপত্তা ও মর্যাদা সৃষ্টি: পরিবারের কাছ থেকেই শিশু তার সামাজিক নিরাপত্তা ও মর্যাদা সম্পর্কে সচেতন হয়। পরিবারের অভ্যন্তরীণ সদস্যদের মধ্যে ছোট বড়দের স্নেহ-মর্যাদার প্রক্রিয়া শিশুর মনে মর্যাদাবোধের সৃষ্টি করে। তাছাড়া পরিবারে বসবাসরত অবস্থায় একটি শিশু সমাজের বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করে। এ সকল জ্ঞানের সমষ্টিই পরবর্তীতে শিশুর ব্যক্তিজীবনে সামাজিক নিরাপত্তা ও মর্যাদা বোধের সৃষ্টি করে।

শিশু সম্পূর্ণ পরিবারের ওপর নির্ভরশীল: শিশু তার সকল চাহিদা পূরণে সম্পূর্ণরূপে পরিবারের ওপর নির্ভরশীল। বস্তুত পরিবারই তাকে পরিপূর্ণ জীবনের সন্ধান দেয়। শৈশবকালে পরিবার থেকে প্রাপ্ত দিকনির্দেশনা শিশুর বার্ধক্য পর্যন্ত প্রভাব বিস্তার করে। 

ব্যক্তিত্ব গঠনে পরিবারের প্রভাব: শিশুরা স্বভাবতই অনুকরণপ্রিয়। মানব শিশু তার পারিবারিক সদস্যদের সাথে অন্তরঙ্গ সম্পর্কে আবদ্ধ থাকে। এ কারণে মানুষের ব্যক্তিত্ব গঠনের ক্ষেত্রে পরিবারের প্রভাব বেশি কার্যকর হয়। পরিবারের বড় সদস্যদের ব্যক্তিত্ব শিশুর ব্যক্তিত্ব গঠনে ব্যাপকভাবে প্রভাব বিস্তার করে।

সামাজিকীকরণে ধর্মের ভূমিকা নিম্নরূপ: মানুষ ধর্ম দ্বারা সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হয়। ধর্মীয় নিয়ম অনুযায়ী প্রতিটি পরিবারই নির্দিষ্ট কিছু কাজ করে যেমন বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যোগদান, ধর্মগ্রন্থ পাঠ করা এবং অনেকে জীবন পরিচালনায় ধর্মীয় মনীষীদের জীবনাদর্শ অনুসরণ করা। এসব বিষয় শিশুর ভবিষ্যৎ জীবনকে প্রভাবিত করে এবং পরবর্তীতে তার আদর্শ বিশ্বাস ও জীবন ধারা সে অনুযায়ী পরিচালিত হয়। 

সামাজিক নিয়ন্ত্রণ: অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন ব্যক্তিকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়। তাই ব্যক্তির উপর সামাজিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় ধর্মের ভূমিকা অনস্বীকার্য। যারা প্রকৃত ধার্মিক এবং যাদের ধর্মের নিয়মাবলীর প্রতি শতভাগ আস্থা ও বিশ্বাস রয়েছে তারা পাপাচার থেকে দূরে থাকে। এর ফলে সমাজের শৃঙ্খলা বজায় থাকে।

সামাজিক সংহতির ধারণা লাভ: সামাজিক সংহতি বলতে মানসিক ঐক্যকে বোঝানো হয়, যার দ্বারা মানুষ পরস্পরের সাথে সম্পৃক্ত। আর এধরণের সম্পর্ক প্রতিস্থাপনে ধর্মের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি লক্ষনীয়। কেননা, একই ধর্মের অনুসারীরা জাতি-বর্ণের ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে তারা আত্মিক বন্ধনে আবদ্ধ থাকে। যার ফলে শিশুমনে সামাজিক সংহতির ধারণা জন্মায়। 

আরো পড়ুন: এরিস্টটলের মতে বিপ্লবের কারণ

ব্যাখ্যা দানের ক্ষমতা সৃষ্টি: শিশুমন কৌতূহলপূর্ণ। তাদের মধ্যে সবসময় রহস্যময় বিষয়ের ব্যাখ্যা জানার আগ্রহ দেখা যায়। পৃথিবীর সৃষ্টির রহস্য, মানব সৃষ্টির উদ্দেশ্য এসকল রহস্যময় বিষয়ের সুন্দর ও সাবলীল ব্যাখ্যা তারা সহজেই ধর্মগ্রন্থ থেকে পেয়ে থাকে। এর ফলে তারা বাস্তব জীবনে সম্মুখীন হওয়া বিভিন্ন প্রশ্নের ব্যাখ্যা দানের মাধ্যমে সমাধান বের করতে পারদর্শী হয়ে ওঠে।

হতাশা থেকে মুক্তি লাভ: মানুষ হতাশাগ্রস্থ আর ধর্ম মানুষকে হতাশ হওয়া থেকে বিরত থাকতে বলেছে। মানবসমাজ যেমন হতাশায় জর্জরিত ধর্মগ্রন্থও ঠিক তেমনি তার সমাধানে পরিপূর্ণ। তাছাড়া অনেক সময় মানুষ ধর্মগ্রন্থ অথবা ধর্মীয় সঙ্গীত শ্রাবণের মাধ্যমে মনের সজীবতা ফিরিয়ে আনতে পারে। ধর্মের অনুপ্রেরণা ব্যক্তির সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়া কে গতিশীল করে।
উপসংহার: পরিশেষে আমরা বলতে পারি, শিশু যে প্রক্রিয়ায় নিজেকে সমাজ উপযোগী করে গড়ে তোলে তাই সামাজিকীকরণ। জন্মগতভাবে শিশু প্রথমেই পারিবারিক শিক্ষা লাভ করে এবং পরবর্তীতে ধর্মীয় ভাবাদর্শের দ্বারা নিজেকে প্রভাবিত করে নিজেকে সামাজিক জীব হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে। তাই পরিবারও ধর্ম সামাজিকরণের দুটি কার্যকর ও মৌলিক বাহন হিসেবে গ্রহণীয়।

Shihabur Rahaman
Shihabur Rahaman
Articles: 33