বাংলাদেশের শিল্পায়নের প্রতিবন্ধকতা সমূহ আলোচনা কর।
বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ এদেশের সমাজ ও সংস্কৃতিতে নগরায়ন ও শিল্পায়নের যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে। বাংলাদেশের সমাজ ও সংস্কৃতিতে শিল্পায়নের সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়ছে। কিছু নেতিবাচক দিক থাকলেও শিল্পায়ন এবং নগরায়নের ফলে নতুন নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি, সামাজিক কাঠামোর পরিবর্তন, সামাজিক গতিশীলতা, মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন সহ নানা পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়। নিম্নে বাংলাদেশের সমাজ ও সংস্কৃতিতে শিল্পায়নের প্রভাব এবং প্রতিবন্ধকতা সমূহ আলোচনা করা হলো।
বাংলাদেশের সমাজ ও সংস্কৃতিতে শিল্পায়নের প্রভাব ও প্রতিবন্ধকতা সমূহঃ শিল্পায়ন হলো একটি অর্থনৈতিক প্রক্রিয়া যাতে কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি থেকে শিল্পভিত্তিক অর্থনীতিতে রূপান্তর ঘটে। এই প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে শিল্পের উৎপাদন, বিকাশ এবং বিস্তার। শিল্পায়ন অর্থনীতিতে উৎপাদন বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, রপ্তানি আয় বৃদ্ধি এবং জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
শিল্পায়নের পরিচয়: শিল্পায়ন শব্দটির ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো ‘Industrialization’। যা ল্যাটিন শব্দ Industria হতে উৎপন্ন হয়েছে। আর Industria শব্দের অর্থ হলো কর্মকাণ্ড বা উদ্যোগ। বৃহৎ অর্থে কোনো খাতে বৃহৎ যান্ত্রিক উৎপাদন সৃষ্টির প্রক্রিয়াকে শিল্পায়ন বলা হয়।
আরো পড়ুন: গ্রাম থেকে শহরের স্থানান্তরের কারণ ও ফলাফল
বাংলাদেশে শিল্পায়নের প্রভাবঃ বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ। শিল্পায়ন এই উন্নয়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। সামাজিক পরিবর্তনে শিল্পায়নের প্রভাব খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। বাংলাদেশে শিল্পায়নের প্রভাব নিম্নরূপ:
১। কর্মসংস্থান সৃষ্টি: শিল্পায়ন উন্নয়নশীল দেশসমূহের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ। শিল্পায়নের ফলে নতুন নতুন শিল্পের বিকাশ ঘটে এবং নতুন নতুন কর্মক্ষেত্র তৈরি হয়। এতে গ্রামীণ সমাজ থেকে শহরে আগত ব্যক্তিবর্গ কাজের সুযোগ পায়। রাষ্ট্রের জনগণকে দক্ষ জনবল হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে শিল্পায়ন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
২। উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি: শিল্পায়নের ফলে উৎপাদন প্রক্রিয়াতে যান্ত্রিকীকরণ ও আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি পায়। এর ফলে কৃষকদের ফসল উৎপাদনের ক্ষেত্রে খরচ কমে আসে এবং উৎপাদন বৃদ্ধি পায়।
৩। রপ্তানি আয় বৃদ্ধি: শিল্পায়নের ফলে শিল্প ক্ষেত্রে উৎপাদন অনেকাংশে বেড়ে যায় যার ফলশ্রুতিতে রপ্তানিযোগ্য পণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। রপ্তানি যোগ্য পণ্য উৎপাদন বেশি হওয়ার ফলে এগুলো থেকে দেশের রপ্তানি আয় বৃদ্ধি পায়।
৪। সমাজ কাঠামোয় পরিবর্তন: শিল্পায়নের ফলে সমাজের শ্রেণি কাঠামোয় পরিবর্তন সাধিত হয়। এছাড়া নগরে বিভিন্ন বিষয়ে বহুমুখী সুযোগ-সুবিধা থাকায় সমাজের নানা শ্রেণির মানুষ শহরে ভীড় জমায়। শিল্পায়নের ফলে প্রভাবে অত্যাধিক পরিমাণ কর্মসংস্থানের সুযোগে সৃষ্টি হয় যার মাধ্যমে গ্রাম থেকে ছুটে আসা অসংখ্য মানুষের কর্মসংস্থান নিশ্চিত হয়।
৫। পেশাগত বৈচিত্র: শিল্পায়নের ফলে সমাজে পেশাগত বৈচিত্র দেখা যায়। সমাজে নানা পেশার মানুষ তারা তাদের পূর্বের পেশা পরিবর্তন করে নতুন পেশায় যুক্ত হওয়ার সুযোগ পায়। এতে করে মানুষের মধ্যে পেশাগত বৈচিত্র পরিলক্ষিত হয়।
আরো পড়ুন: সুশাসন বলতে কি বুঝায়?
৬। সামাজিক গতিশীলতা বৃদ্ধি: নগরায়ণ ও শিল্পায়নের ফলে সামাজিক গতিশীলতা বৃদ্ধি পায়। বিভিন্ন পেশার সুযোগ থাকায় গ্রাম ও নগরবাসীদের মধ্যে দ্রুত গতিতে আর্থ-সামাজিক পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। আর সামাজিক গতিশীলতার কারণে মানুষের জীবন যাত্রার মান উন্নত হয়।
৭। আধুনিক প্রযুক্তির বিকাশ: শিল্পায়নের ফলে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার ও বিকাশ ঘটে থাকে। উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা, বহুমুখী সংস্কৃতি, পারস্পরিক সম্পর্ক, দৈনন্দিন জীবন-যাপন প্রভৃতি ক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার ও বিকাশে শিল্পায়ন গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব পরিলক্ষিত হয়।
৮। গ্রামীণ জীবনে প্রভাব: গ্রামীণ সংস্কৃতি তথা গ্রামীণ জীবনের উপর নগর সংস্কৃতির প্রভাব সুস্পষ্ট। শিল্পায়নের ফলে গ্রামের ঐতিহ্যবাহী জীবনপ্রণালী যেমন- ঘরবাড়ি, আসবাবপত্র, পোশাক-পরিচ্ছদ, খাদ্যাভ্যাস, সাংস্কৃতিক আচার-প্রথা, ঐতিহ্য ইত্যাদিতে যেমন পরিবর্তন হয় তেমনি বিভিন্ন ধ্যান-ধারণার ক্ষেত্রেও নগরের প্রভাব গ্রামীণ জীবনের উপর প্রভাব বিস্তার করে।
৯। স্থানান্তর গমন ত্বরান্বিত হয়: শিল্পায়নের ফলে মানুস গ্রাম ছেড়ে শহরে স্থানান্তরের সুযোগ পায়। এর ফলে উন্নয়নশিল দেশের অপেক্ষাকৃত দরিদ্র জনগোষ্ঠীর একটি অংশ কর্মসংস্থানের তাগিদে শিল্প নগরে অবস্থান শুরু করে এবং যোগ্যতা অনুযায়ী কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে সক্ষম হয়।
১০। আন্তর্জাতিক যোগাযোগ: শিল্পায়নের ফলে বর্হিবিশ্বের সাথে অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক, রাজনৈতিক, কুটনৈতিক ও সাংস্কৃতিক যোগাযোগ অনেক বৃদ্ধি পায় যা বিশ্বায়নকে ত্বরান্বিত করে। বিশ্বায়নের ফলে নানা ক্ষেত্রে আন্তঃরাষ্ট্রীয় যোগাযোগে নতুন গতি সঞ্চারিত হয়।
১১। জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে অবদান: শিল্পায়ন জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। বিবিএস এর সাময়িক হিসাব অনুযায়ী ২০২১ – ২২ অর্থবছরে বাংলাদেশে জিডিপিতে শিল্প খাতের অবদান ৩৭.০৭ শতাংশ ২০২০ – ২১ অর্থবছরে জিডিপিতে এখাতের অবদান ছিল ৩৬.০১ শতাংশ।
১২। জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন: শিল্পায়নের ফলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটে এতে মানুষের দৈনন্দিন আয় বৃদ্ধি পায়। এর ফলে শিক্ষা,বাসস্থান, যোগাযোগ ব্যবস্থা, স্বাস্থ্যসেবা, সামাজিক নিরাপত্তার সহ সকল ক্ষেত্রে জীবনযাত্রার মানের উন্নতি ঘটে।
আরো পড়ুন: চাকমা সমাজের আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবন
প্রতিবন্ধকতাঃ শিল্পায়নের ফলে বাংলাদেশের সমাজ ও সংস্কৃতিতে বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধকতা পরিলক্ষিত হয় যা সমাজ সংস্কৃতির জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। যেমনঃ
- পরিবেশ দূষণ: শিল্প-কারখানার অতিরিক্ত বর্জ্যের ফলে ফলে পরিবেশ দূষিত হয় যা জনজীবনের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।
- সামাজিক সমস্যা: শ্রমিকদের মধ্যে শোষণ, নির্যাতন, এবং অন্যান্য সামাজিক সমস্যা দেখা দেয়।
- অর্থনৈতিক বৈষম্য বৃদ্ধি: শিল্প মালিকদের এবং শ্রমিকদের মধ্যে আয়ের ব্যবধান বৃদ্ধি পায়।
- মানবসম্পদের ঘাটতি: দক্ষ শ্রমিকের অভাব রয়েছে।
- অবকাঠামোগত ঘাটতি: বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি সরবরাহ, এবং পরিবহনে নানারকম সমস্যা বিদ্যমান ।
উপসংহারঃ পরিশেষে বলা যায়, শিল্পায়ন একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক প্রক্রিয়া যা একটি দেশের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অন্যদিকে অপরিকল্পিত শিল্পায়ন ব্যবস্থা শহরবাসীর শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা ও বিনোদনের ব্যবস্থা ব্যাহত করে। তাই শিল্পায়নের ইতিবাচক ও নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে। এই প্রক্রিয়াগুলোর সুফল ভোগ করার জন্য এবং এর প্রতিবন্ধকতাগুলো মোকাবেলা করার জন্য সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও নীতিমালা প্রণয়ন করা অত্যাবশ্যক।