সমাজবিজ্ঞানের বৈশিষ্ট/স্বরূপ আলোচনা করো।
ভুমিকাঃ সমাজবিজ্ঞান এমন একটি শাস্ত্র যা মানুষের সমাজ, সামাজিক সম্পর্ক, এবং সমাজে মানুষের আচরণ ও প্রভাব সম্পর্কে অধ্যয়ন করে। এটি একটি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির মাধ্যমে সমাজের গঠন, কার্যপ্রণালী এবং পরিবর্তনের বিষয়গুলো বিশ্লেষণ করে। সমাজবিজ্ঞানের মাধ্যমে সমাজে বিভিন্ন শ্রেণি, গোষ্ঠী, সংস্কৃতি এবং প্রতিষ্ঠানগুলোর কাজ ও ভূমিকা বুঝতে সাহায্য করে।
শাব্দিকভাবে সমাজবিজ্ঞান জ্ঞানের সেই শাখা যা সাধারণীকরণ বা বিমূর্তায়ন পর্যায়ে সমাজ সম্পর্কে আলোচনা করে। সমাজবিজ্ঞান সামাজিক বিজ্ঞানসমূহের (রাষ্ট্রবিজ্ঞান, অর্থনীতি, সমাজকল্যাণ, নৃ – বিজ্ঞান ইত্যাদি) অন্যতম যার প্রধান আলোচ্য বিষয় সমাজ। তাই সমাজের বিজ্ঞান হিসেবেই এর পরিচয়। মূলত সমাজে বসবাসকারী মানুষের পারস্পরিক যে সম্পর্ক গড়ে ওঠে তা বিশ্লেষণ করার প্রয়োজন থেকেই সমাজবিজ্ঞানের উদ্ভব হয়েছিল।
আরো পড়ুনঃ পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্যমূলক নীতিসমূহ
সমাজবিজ্ঞানের প্রকৃতি ও স্বরূপ
সমাজবিজ্ঞান হল সামাজিক বিজ্ঞান। তাই ম্যাক্স ওয়েবার সমাজবিজ্ঞানকে সামাজিক কর্মকাণ্ড সম্বন্ধীয় বিজ্ঞান হিসেবে অভিহিত করেছেন। সমাজতত্ত্বের প্রকৃতি যে সমস্ত দিক থেকে পরিলক্ষিত হয়, সেগুলি হল নিম্নলিখিত –
১. আদর্শনিষ্ঠ বিজ্ঞানঃ সমাজ বিজ্ঞান হল একটি আদর্শনিষ্ঠ বিজ্ঞান। এখানে সমাজের যাবতীয় বিষয় সুনির্দিষ্ট ভাবে উল্লেখ করা হয়ে থাকে। তাই সমাজবিজ্ঞানের প্রকৃতি হল এটি আদর্শনিষ্ঠ বিজ্ঞান।
২. সমাজের বিজ্ঞানঃ সমাজবিজ্ঞান সম্পূর্ণ সামাজিক প্রকৃতির। অর্থাৎ সমাজের সমস্ত কিছু বিষয় আলোচনা করা হয়ে থাকে। সমাজকে কেন্দ্র করে এই বিজ্ঞান গঠিত হয়। ব্যক্তির থেকে সমাজের গুরুত্ব অধিক ভাবে আরোপিত করা হয়। তাই সমাজবিজ্ঞানের প্রকৃতি হল এটি সমাজের বিজ্ঞান।
৩. বিজ্ঞানসম্মত বা পদ্ধতিগত বিজ্ঞানঃ সমাজবিজ্ঞানে যে সমস্ত বিষয় আলোচনা করা হয় সেগুলি সবকিছুই বিজ্ঞানসম্মত ভাবে উল্লেখ করা থাকে। অর্থাৎ সমাজবিজ্ঞানের আলোচ্য বিষয়বস্তু বিজ্ঞানসম্মত বা পদ্ধতিগতভাবে উল্লেখিত হয়। তাই সমাজবিজ্ঞানের প্রকৃতি হল এটি বিজ্ঞানসম্মত বা পদ্ধতিগত বিজ্ঞান।
৪. স্বতন্ত্র বিজ্ঞানঃ সমাজবিজ্ঞান সম্পূর্ণ স্বাধীন প্রকৃতির। অর্থাৎ সমাজবিজ্ঞানের আলোচ্য বিষয়বস্তুগুলির মধ্যে স্বতন্ত্রতা পরিলক্ষিত হয়। তাই সমাজবিজ্ঞান সম্পূর্ণভাবে স্বতন্ত্র প্রকৃতির হয়ে থাকে।
৫. তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক প্রকৃতিরঃ সমাজবিজ্ঞান একদিকে যেমন বিভিন্ন তত্ত্বের উল্লেখ করে থাকে অপরদিকে তেমনি সেগুলির বাস্তব ক্ষেত্রে প্রয়োগ করে থাকে। তাই সমাজবিজ্ঞান একদিকে যেমন তাত্ত্বিক প্রকৃতির অন্যদিকে তেমনি ভাবে ব্যবহারিক প্রকৃতির হয়ে থাকে। অর্থাৎ সমাজের মধ্যে ব্যক্তির অবস্থান কি হবে এবং ব্যক্তি কিভাবে জীবন ধারণ করবে বা সমাজের মধ্যে টিকে থাকবে সেগুলি সবই সমাজবিজ্ঞান আলোকপাত করে থাকে।
৬. সর্বজনীন বিষয়ঃ সমাজবিজ্ঞান সর্বজনীন প্রকৃতির। অর্থাৎ সমাজের সকল মানুষের পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ার ফলে সমাজের সৃষ্টি হয়। তাই ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে সমাজের যাবতীয় বিষয় নির্ধারিত হয়ে থাকে। সমাজ কল্যাণ সাধনের মধ্য দিয়ে ব্যক্তি কল্যাণ সম্ভব করা হয়। তাই যে সমাজ যত বেশি উন্নত সেই সমাজের ব্যক্তিবর্গের জীবনযাত্রার মান তত বেশি উন্নত।
আরো পড়ুনঃ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পরাশক্তির ভূমিকা
সমাজবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু
মানুষ সমাজবদ্ধ জীব। মানুষের জীবন বিশ্লেষণ করাই হলাে সমাজবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু। সমাজবিজ্ঞান হচ্ছে সমাজের পূর্ণাঙ্গ বিজ্ঞানভিত্তিক পাঠ। তাই বলা যায়, গােটা সমাজই সমাজবিজ্ঞানের আওতাভুক্ত। বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানীর দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে আমরা সমাজবিজ্ঞানের বিষয়বস্তুকে নিম্নলিখিতভাবে দেখতে পারি। যথা-
(১) সামাজিক প্রতিষ্ঠানঃ মানুষ তার বহুমুখী প্রয়োজন মেটানোর জন্য গড়ে তােলে প্রতিষ্ঠান। সমাজের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয়, পারিবারিক, শিক্ষামূলক, বিনোদনমূলক ইত্যদি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কার্যধারা, উৎপত্তি ও সমাজের ওপর প্রভাব সমাজবিজ্ঞানে আলোচিত হয়।
(২) সামাজিক স্তরবিন্যাসঃ সামাজিক স্তরবিন্যাস সমাজবিজ্ঞানের অন্যতম প্রধান আলোচ্য বিষয় হিসেবে স্বীকৃত। স্তরবিহিন কোনাে সমাজ আজ পর্যন্ত দেখা যায়নি। সমাজ নানা স্তরে বিন্যস্ত। ব্যক্তিগত সম্পত্তির আবির্ভাবের ফলে স্তরবিন্যাস আরও তীব্র হয়েছে। সমাজবিজ্ঞান এসব স্তর নিয়েও আলোচনা করে।
(৩) সামাজিক গতিশীলতাঃ পৃথিবী নিয়ত পরিবর্তনশীল যার সাথে তাল রেখে মানুষের জীবনেও গতিশীলতার এসেছে। তাই সমাজবিজ্ঞান সামাজিক গতিশীলতার বস্তুনিষ্ঠ বা বিজ্ঞানভিত্তিক বিশ্লেষণ প্রদান করে থাকে। নিয়ত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে, সমাজ ক্রমাগত এগিয়ে চলেছে। তাই সামাজিক পরিবর্তন সমাজবিজ্ঞানের পরিধিভুক্ত।
(৪) সামাজিক সমস্যাঃ সমাজে বসবাস করতে গিয়ে যদিও মানুষ সংঘবদ্ধ তারপরও কিছু সামাজিক সমস্যা দেখা দেয়। তাই সমাজে বসবাস করতে গিয়ে এ সকল সমস্যা সমাধান মানুষেরই করতে হয়। তাই সমাজবিজ্ঞান সামাজিক সমস্যা ও তার সমাধানের উপায় নির্দেশ করে।
(৫) সামাজিক সম্পর্কঃ মানুষ সামাজিক জীব। সমাজের বাইরে কেউ জীবনযাপন করতে পারে। আর সমাজে বসবাস করতে গিয়ে প্রত্যেকে তার পার্শ্ববর্তী মানুষের তার সম্পর্ক গড়ে তুলে যাকে সামাজিক সম্পর্ক বলা হয়। সমাজবিজ্ঞান সামাজিক সম্পর্কসমূহের বিশ্লেষণ ও সামাজিক ঘটনাসমূহের সমাজতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দিয়ে থাকে।
(৬) সামাজিক কাঠামোঃ সমাজ জনসংখ্যার সমষ্টি। জনসংখ্যার ঘনত্বের জন্য সমাজকাঠামােতে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানে জনসংখ্যা বিশেষ প্রভাব ফেলে। তাই সমাজবিজ্ঞান জনসংখ্যা নিয়েও আলোচনা করে।
আরো পড়ুনঃ আগরতলা মামলার কারণ ও ফলাফল
উপসংহারঃ সমাজবিজ্ঞান হলাে সমাজ সম্পর্কিত বিজ্ঞানভিত্তিক বা বস্তুনিষ্ঠ অধ্যয়ন। ব্যক্তি এবং সমাজজীবনের পূর্ণাঙ্গ চিত্র এতে স্থান পেয়েছে, তাই এর বিষয়বস্তু অত্যন্ত ব্যাপক। সমাজের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় তথা মানুষের যাবতীয় মানবীয় আচরণ সম্পর্কে জানতে হলে সমাজবিজ্ঞান পাঠের গুরুত্ব অপরিসীম।