বাংলাদেশের সমাজের উপর অতিনগরায়নের প্রভাব বর্ণনা

অতিনগরায়ন কি? উন্নয়নশীল/বাংলাদেশের সমাজের উপর অতিনগরায়নের প্রভাব বর্ণনা

ভূমিকাঃ অতিনগরায়ন বলতে অত্যন্ত দ্রুতগতিতে ও পরিকল্পনাহীনভাবে শহরের জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং নগরায়ন প্রক্রিয়াকে বোঝায়। এটি এমন একটি প্রক্রিয়া যেখানে শহরগুলোর জনসংখ্যা, অবকাঠামো, এবং অর্থনৈতিক কার্যকলাপ বৃদ্ধি পায়, যা স্থানীয় পরিবেশ ও সামাজিক কাঠামোর উপর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে অতিনগরায়নের প্রভাব ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয়ই হতে পারে।

অতিনগরায়নের সংজ্ঞা ও কারণ: অতিনগরায়ন মূলত দুইটি প্রধান কারণে ঘটে:

১. গ্রাম থেকে শহরে মানুষের স্থানান্তর: কর্মসংস্থানের সুযোগ, আধুনিক জীবনের সুবিধা, এবং উন্নত জীবনযাত্রার প্রত্যাশা মানুষকে শহরমুখী করে তোলে।

আরো পড়ুনঃ অখণ্ড স্বাধীন বাংলা গঠনের পরিকল্পনা

২. জনসংখ্যা বৃদ্ধি: অধিক জনসংখ্যার চাপ শহরের সীমাবদ্ধ স্থানের উপর ক্রমাগত বেড়ে যায়, ফলে পরিকল্পনাহীন আবাসন, অবকাঠামো নির্মাণ, এবং যানজটের সৃষ্টি হয়।

বাংলাদেশে অতিনগরায়নের একটি বড় উদাহরণ হলো ঢাকা শহর, যা বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ শহর। গ্রাম থেকে শহরে মানুষের ব্যাপক স্থানান্তর এবং শিল্পায়ন এই শহরকে অতিনগরায়নের শীর্ষে নিয়ে গেছে।

বাংলাদেশের সমাজের উপর অতিনগরায়নের প্রভাব:

১. অর্থনৈতিক প্রভাব: অতিনগরায়ন কিছু ইতিবাচক অর্থনৈতিক প্রভাব ফেলে। শহরে বিভিন্ন শিল্পকারখানা, প্রযুক্তি কেন্দ্র, এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়। তবে এটি দীর্ঘমেয়াদে সমস্যার কারণও হয়ে দাঁড়ায়। বেকারত্ব, মজুরি বৈষম্য, এবং অপ্রশিক্ষিত শ্রমিকের চাহিদার অভাবে অর্থনৈতিক অস্থিরতা দেখা দেয়।

২. পরিবেশগত ক্ষতি: অতিনগরায়ন পরিবেশের উপর গভীর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। উদাহরণস্বরূপ:

বায়ুদূষণ: যানবাহনের সংখ্যা বৃদ্ধি, শিল্পকারখানার বর্জ্য, এবং অপরিকল্পিত নগরায়ন বায়ুমানকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করে।

i) জলাভূমি ধ্বংস: শহরের প্রসারের জন্য জলাভূমি ভরাট করে নির্মাণ কাজ করা হয়, যা পরিবেশগত ভারসাম্য নষ্ট করে।

ii) তাপমাত্রা বৃদ্ধি: গাছপালা কেটে কংক্রিটের অবকাঠামো তৈরির ফলে শহরের তাপমাত্রা ক্রমশ বাড়ছে।

৩. সামাজিক বৈষম্য বৃদ্ধি: অতিনগরায়ন সমাজে বৈষম্যের সৃষ্টি করে। অর্থনৈতিক ও সামাজিক সেবা যেমন স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, এবং বিনোদনের সুযোগ শুধুমাত্র উচ্চবিত্তদের কাছে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ বঞ্চিত থাকে, ফলে তাদের মধ্যে হতাশা এবং অসন্তোষ বাড়ে।

৪. অপরাধ বৃদ্ধি: অত্যধিক জনসংখ্যার চাপ, বেকারত্ব, এবং সামাজিক বৈষম্য অপরাধের মাত্রা বৃদ্ধি করে। বিশেষ করে মহানগর এলাকায় ছিনতাই, ডাকাতি, এবং মাদকের ব্যবহার বৃদ্ধি পায়।

৫. পরিবহন ব্যবস্থার সংকট: অতিনগরায়নের ফলে যানজট এবং অপরিকল্পিত রাস্তাঘাটের সমস্যা প্রকট হয়। প্রতিদিন লাখ লাখ মানুষ যানজটে আটকে পড়ে, যা সময় ও অর্থের অপচয় ঘটায়। ঢাকা শহর এর একটি প্রধান উদাহরণ।

৬. স্বাস্থ্যগত সমস্যা: অতিনগরায়ন স্বাস্থ্য সমস্যারও কারণ হয়ে দাঁড়ায়। পরিবেশ দূষণ, অপর্যাপ্ত পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা, এবং আবাসনের সংকট রোগব্যাধি বৃদ্ধি করে। বিশেষ করে বস্তি এলাকায় ডায়রিয়া, টাইফয়েড, এবং ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ বেশি দেখা যায়।

৭. সামাজিক বন্ধন দুর্বল হওয়া: গ্রামীণ পরিবেশে মানুষ একে অপরের সাথে গভীর সামাজিক বন্ধনে আবদ্ধ থাকে। কিন্তু শহরের অতিনগরায়নে এই বন্ধনগুলো দুর্বল হয়ে যায়। অপরিচিতি এবং ব্যস্ত জীবনের কারণে সামাজিক সম্পর্ক ক্রমেই ক্ষীণ হয়ে পড়ে।

৮. জীবনযাত্রার মানের অবনতি: যদিও অতিনগরায়নের ফলে কিছু সুবিধা তৈরি হয়, তবে মানুষের জীবনযাত্রার মান অবনতির দিকে যায়। অপরিকল্পিত নগরায়ন এবং সীমিত সম্পদের কারণে শহরের মানুষ চাপে থাকে।

৯. স্বাস্থ্যসেবার সংকটঃ অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপের কারণে শহরের হাসপাতাল এবং ক্লিনিকগুলোতে পর্যাপ্ত সেবা প্রদান সম্ভব হচ্ছে না। এতে নিম্ন আয়ের মানুষগুলো সঠিক চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

আরো পড়ুনঃ বাংলাদেশের জনগণের নৃ-তাত্ত্বিক পরিচয়

১০. শিক্ষার সংকটঃ অতিরিক্ত জনসংখ্যার কারণে স্কুল ও কলেজগুলোতে শিক্ষার্থীদের উপচে পড়া ভিড় দেখা যায়। এতে শিক্ষার মান নিম্নগামী হচ্ছে এবং শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় মনোযোগের অভাব তৈরি হচ্ছে।

১১. জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবঃ অতিনগরায়নের ফলে শহরের তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। গাছপালা কেটে ফেলে নির্মাণ কাজ করার কারণে শহরের আবহাওয়া দিন দিন পরিবর্তিত হচ্ছে, যা জলবায়ুর উপর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলছে।

১২. বস্তির প্রসার ও মানবিক সংকটঃ অতিরিক্ত মানুষকে আশ্রয় দেওয়ার জন্য শহরে বস্তির সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বস্তিগুলোতে মানুষের জীবনযাত্রা অত্যন্ত মানবেতর, যেখানে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, এবং নিরাপত্তার অভাব প্রকট।

১৩. সামাজিক সংহতির ক্ষতিঃ গ্রাম থেকে শহরে আসা মানুষের মধ্যে সামাজিক সম্পর্ক দুর্বল হয়ে যায়। শহরের ব্যস্ততা এবং একাকিত্বের কারণে মানুষ দিন দিন আরো বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে।

১৪. জল নিষ্কাশন ও পানির সমস্যাঃ অপরিকল্পিত নির্মাণের ফলে শহরে জল নিষ্কাশনের ব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বৃষ্টি হলে পানি জমে যায় এবং শহরজুড়ে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি করে। এছাড়া বিশুদ্ধ পানির সংকটও প্রকট।

১৫. পরিকল্পিত নগরায়নের অভাবঃ বাংলাদেশের শহরগুলোতে পরিকল্পিত নগরায়নের অভাবে নগর জীবনের মান ক্রমশ অবনতি হচ্ছে। যদি পরিকল্পনামাফিক নগরায়ন করা যেত, তবে পরিবেশগত ও সামাজিক সমস্যাগুলো অনেকাংশে কমানো সম্ভব হতো।

১৬. বেকারত্ব ও অপরাধ বৃদ্ধিঃ  অতিরিক্ত মানুষ শহরের শ্রমবাজারে প্রবেশ করলেও পর্যাপ্ত কর্মসংস্থানের অভাবে বেকারত্ব বেড়েছে। এর ফলে ছিনতাই, মাদকদ্রব্য ব্যবহার, এবং অন্যান্য অপরাধ বৃদ্ধি পাচ্ছে।

উত্তরণের উপায়: অতিনগরায়নের প্রভাব থেকে মুক্তি পেতে কিছু কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি:

১. পরিকল্পিত নগরায়ন: সরকারের উচিত শহরগুলোর অবকাঠামো পরিকল্পনা করে উন্নয়ন করা।

২. গ্রামীণ উন্নয়ন: গ্রামে কর্মসংস্থান ও সুযোগ-সুবিধা বাড়ালে মানুষ শহরমুখী হবে না।

৩. পরিবেশ সংরক্ষণ: পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহার করে শিল্পকারখানা পরিচালনা করতে হবে।

৪. জনসচেতনতা বৃদ্ধি: নগরায়নের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করতে হবে।

আরো পড়ুনঃ আগরতলা মামলার কারণ ও ফলাফল

৫. উন্নত পরিবহন ব্যবস্থা: যানজট কমাতে আধুনিক ও টেকসই পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তোলা জরুরি।

উপসংহার: অতিনগরায়ন একটি বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ হলেও বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে এর প্রভাব আরও প্রকট। এটি অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে কিছু সুবিধা নিয়ে এলেও দীর্ঘমেয়াদে পরিবেশ ও সামাজিক কাঠামোর উপর গুরুতর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। তাই টেকসই নগরায়নের জন্য সুপরিকল্পিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি।

Sima Khatun
Sima Khatun

আমি সিমা খাতুন। আমি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি বিষয়ে অনার্স ও মাস্টার্স
কমপ্লিট করেছি। ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে আমার অনেক অভিজ্ঞতা রয়েছে। আমি শিক্ষার্থীদের ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য সহজভাবে শেখাতে কাজ করি। শিক্ষার্থীদের সাহিত্যের প্রতি আগ্রহ বাড়ানোই আমার লক্ষ্য।

Articles: 128